বিশ্বকাপে বাঙালিদের নজির তৈরির রঙ্গমঞ্চ যে ঐতিহাসিক মাঠ

চামিন্ডা ভাস, মুরলীধরণকে বলে বলে বাউন্ডারিতে পাঠাচ্ছেন একজন বঙ্গসন্তান। ক্রিজের অন্য প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাটসম্যানটি তাঁর অফসাইডকে প্রায় ঐশ্বরিক আখ্যা দিয়েছেন। আজ অবশ্য শুধু অফসাইড নয়, ডিপ মিড উইকেট, লং অন দিয়েও বল ছুটছে সবুজ আউটফিল্ড ধরে। মাঝেমাঝেই উড়ছে আকাশেও। কয়েকটা বল তো গ্যালারির চৌহদ্দি পেরিয়ে সোজা গিয়ে পড়েছে মাঠের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদীতে। বলতে বলতেই কপিল দেবের ১৭৫ রানের মহাকাব্যিক ইনিংসকেও ছাপিয়ে গেলেন সেই বাঁহাতি বঙ্গসন্তান। বিশ্বকাপের মঞ্চে ফের একটা নতুন ইতিহাস জন্ম নিল।
শতাব্দীপ্রাচীন একটা ঐতিহাসিক মাঠ। ছবির মতো সুন্দর। মাঠের ঠিক পিছনেই বয়ে চলেছে নদী। মাঠের মাঝখান থেকে দেখা যায় গির্জার চুড়ো। আর এমন ঐতিহাসিক মাঠই হয়ে উঠেছে বাঙালিদের ইতিহাস সৃষ্টির রঙ্গমঞ্চও। না না, ভুলেও কেউ ইডেন গার্ডেন্স-এর কথা ভাববেন না। কথা হচ্ছে ইল্যান্ডের টনটন কাউন্টি গ্রাউন্ড নিয়ে। এই মাঠেই সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক ১৮৩ রান। আর এই মাঠেই ক’দিন আগে বাংলাদেশের ক্যারিবিয়ানদের বিরুদ্ধে ৩২২ রান তাড়া করে ঐতিহাসিক জয়। টনটন আর বাংলার টান নেহাত ছোটো নয়।
সামারসেট কাউন্টি দলের মাঠ এই টনটন। ঠিক যেন একটুকরো পোস্টকার্ড। এই মাঠে প্রথম খেলা হয়েছিল সেই ১৮৮২ সালে, হ্যাম্পশায়ার আর সামারসেটের মধ্যে। ছোটো মাঠ, ছিমছাম আটপৌরে প্যাভিলিয়ন। গ্যালারির মধ্যেও সবুজ বিছিয়ে। চেস্টনাট গাছের ছায়া। প্যাভিলিয়নের একটা অংশকে ডাকা হত ‘হেন কুপ’ বলে। সেখানে টনটনের কয়েকজন অভিজাত দর্শক এসে বসতেন খেলা দেখার সময়ে। কোনো সরকারি সংরক্ষণ নেই, দড়ি-শেকল-সাইনবোর্ড দিয়ে ঘিরে রাখাও নেই। কিন্তু ওই নির্দিষ্ট অংশের আসনে কখনোই বসতেন না অন্য কোনো দর্শক। টনটন ক্রিকেট মাঠের ঐতিহ্য এমনটাই।
মাঠের ঠিক পিছন দিয়েই বয়ে চলেছে নদী। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে ভারত-শ্রীলঙ্কা ম্যাচে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের মারা ছক্কার তোড়ে কয়েকবার বল গিয়ে পড়েছিল এই নদীতেই। বিখ্যাত রিভার স্ট্যান্ডটি কিছুদিন আগেই ভাঙা পড়েছে গ্যালারি সম্প্রসারণের সময়। মাঠের ইতিহাস তাতে সামান্য চিড়ও খেয়েছে হয়তো। মাঠ থেকেই স্পষ্ট দেখা যায় দুটি ঐতিহাসিক গির্জা--- সেন্ট জেমস চার্চ এবং সেন্ট ম্যারি ম্যাগডালেনের চার্চ।
এই মাঠের মতোই সুন্দর একটা ইনিংস খেলেছিলেন এখানে ডেভিড গাওয়ার। ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপে। ১৩০ রানের সেই ইনিংসে তুলি বোলানোর মতো একাধিক কভার ড্রাইভ বেরিয়েছিল সেই বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের হাত থেকে। এর ১৬ বছর পরে, ২৬ মে, একই প্রতিপক্ষর বিরুদ্ধে ফের মাঠ কাঁপিয়েছিলেন আরো এক বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। তাঁর কভার ড্রাইভও ঐশ্বরিক। এবং তিনি একজন বঙ্গসন্তান। নাম বলতে পারলে কোনো পুরস্কার নেই।
’৯৯ বিশ্বকাপে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় আর রাহুল দ্রাবিড়ের ঐতিহাসিক পার্টনারশিপ এখানেই। দ্রাবিড় ১২৯ বলে ১৪৫ রান করে আউট হলেও সৌরভ নিজের রানকে টেনে নিয়ে যান ১৮৩-তে। ১৭টা চার আর ৭টা ছক্কায় সাজানো সেই ইনিংস একইসঙ্গে বিধ্বংসী এবং সুন্দর। মনে রাখতে হবে, উল্টোদিকে কিন্তু ছিলেন চামিন্ডা ভাস, মুরলীধরণ, জয়সূর্যর মতো কিংবদন্তিরা। সেইযুগে, যখন পাওয়ার হিটিং এই পর্যায়ে পৌঁছয়নি, এত ভালো ব্যাটের জন্ম হয়নি, তখন ইংল্যান্ডের একটা মাঠে এমন ব্যাটিং-কে অবিশ্বাস্য না বলে উপায় থাকে না। সৌরভ-দ্রাবিড় সর্বোচ্চ রানের পার্টনারশিপের রেকর্ড করেছিলেন এই ম্যাচে। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় ভেঙে দিয়েছিলেন কপিল দেবের ১৭৫ রানের রেকর্ড। তখনো অবধি ৩৭৩ রান ভারতের দলগত সর্বোচ্চ রান ছিল বিশ্বকাপে। এই রেকর্ডের কোনোটাই আর অবশিষ্ট নেই। কিন্তু এখনো বিশ্বকাপে ভারতীয় হিসেবে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড সৌরভের এই ১৮৩-ই।
বিশ্বকাপে বাঙালিদের তৈরি রেকর্ডের সঙ্গে এই মাঠের সম্পর্ক যেন ফুরোতেই চায় না। সম্প্রতি, ১৭ জুন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ৩২২ রানের বিশাল স্কোরকে ৫১ বল বাকি থাকতেই যেমন হেলায় তাড়া করে জিতল বাংলাদেশ। এই নজিরবিহীন রান তাড়া করায় ফের নায়ক হয়ে রইলেন একজন বাঁহাতি বঙ্গসন্তান। সাকিব-আল-হাসান। তাঁর ৯৯ বলে ১২৪ রানের ইনিংসে এ-পার বাংলার ‘মহারাজ’-এর দাপটও যেন মিশে গেল কোথাও। সাকিবকে অসামান্য সঙ্গত দিলেন লিটন দাস। ৬৯ বলে ৯৪ রানের ইনিংসটিকে বিধ্বংসী না বললে অপরাধ হবে। ক্যারিবিয়ান পেস ব্যাটারির টানা বাউন্সার, শর্ট বলকে দুজনেই অবলীলায় পাঠিয়েছেন বাউন্ডারির বাইরে। টনটনের ২২ গজে ফের উজ্জ্বল হয়েছে বাঙালি ক্রিকেটারদের তৈরি করা ইতিহাস।
দুই বাংলার বিচ্ছেদে আসল ভূমিকা ছিল ঔপনিবেশিক প্রভু ব্রিটিশদের। সেই ক্ষত আজো শুকোয়নি। হয়তো শুকোবেও না কোনোদিন। কিন্তু সেই ইংল্যান্ডেরই একটি ক্রিকেট মাঠে বারবার নজির গড়ার ক্ষেত্রে একাকার হয়ে যায় দুই বাংলার ক্রিকেট। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, সাকিব আল হাসান, লিটন দাস—দুটি আলাদা দেশ, আলাদা নাগরিকত্ব। কিন্তু তিনজনেই বঙ্গসন্তান। ম্যাচ শুরুর আগে তিনজনকেই গাইতে হয়েছে একজন বাঙালি কবির লেখা ‘জাতীয় সংগীত’ই। সমাপতন ইতিহাসের ধর্ম। টনটনের মাঠ যেন তেমনই এক ঐতিহাসিক রঙ্গমঞ্চ। যেখানে সমাপতিত হবে দুই বাংলার গৌরব। হোক না তা খেলার ছুতোয়। খেলা কি নিছক খেলা হয়ে থেকেছে নাকি ইতিহাসে?