বাংলার প্রাচীনতম পাথরের দেউল অবস্থিত এখানেই

পশ্চিম বর্ধমান জেলার প্রান্ত বিন্দু বরাকর শহর, যার বহু প্রাচীন নাম বেগুনিয়া। এর পরেই শুরু দামোদর নদ এবং ঝাড়খণ্ড রাজ্যের ধানবাদ জেলার। এখানে পৌঁছোতে হলে যে কোনো ট্রেনে চেপে আসানসোল স্টেশন নেমে যান। ধর্মতলা থেকেও প্রচুর ভলভো বাস আসানসোল আসে। আসানসোল থেকে বরাকর যাওয়ার অগুনতি বাস ও মিনিবাস আছে। আবার black diamond/ coal field এক্স চাপলে, সোজা নামুন বরাকর। এখান থেকে পায়ে হেঁটে বা রিক্সা করে পাঁচ মিনিটে পৌঁছোবেন গন্তব্যে।
দামোদর নদের প্রায় কোল ঘেঁষে আছে এক সুপ্রাচীন-ঐতিহাসিক, নান্দনিক এবং অপরিসীম প্রত্নতাত্বিক মূল্যের মন্দিররাজি। বর্তমানে চারটি অপূর্ব সুন্দর পাথরের দেউল দাঁড়িয়ে আছে(আগে পাঁচটি ছিল), যার সমষ্টিগত নাম সিদ্ধেশ্বর মন্দির। এবং আপনাদের জ্ঞাতার্থে জানাই যে বাংলাদেশের প্রাচীনতম পাথরের দেউল হচ্ছে, এদের মধ্যে যেটি সামনের দিক থেকে শেষ বা চতুর্থ এবং ক্ষুদ্রতমটি। ওড়িশা রেখা বা শিখর রীতিতে তৈরি এই অপূর্ব সুন্দর দেউলগুলি কালের করাল গ্রাস জয় করে এখনো টিকে আছে। এ আমাদের পরম সৌভাগ্য। কিন্তু বাঙালি জাতির চরম ঔদাসীন্য, ঠুঁটো জগন্নাথ কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় অতি উৎসাহী ভক্তদের তাণ্ডবে কতদিন আর টিকবে জানি না। ASI সংরক্ষিত স্থান হলেও, সারাদিন ধরে ভক্তদের ফুল, বেলপাতা, সিঁদুর লেপা এবং ঘড়া ঘড়া জল শিবলিঙ্গের ওপর ঢালা, এত ধর্মের আতিশয্যে, একটি মন্দির বহু আগেই ধ্বংস হয়ে গেছে। Beglar সাহেব পঞ্চম মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ এর বিবরণ দিয়েছেন, এখন সেই পঞ্চম মন্দিরের চিহ্নমাত্র নেই। এ ছাড়াও অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে সামনের বাঁ দিকের মন্দির গাত্রের শিলালিপিটার।

বিনয় ঘোষের লেখা থেকে জানা যায় যে শিলালিপিটিতে লেখা আছে - ১৩৮২ শকাব্দে(বা ৭৮ যোগ করলে ১৪৬০ খ্রিস্টাব্দে) ফাল্গুন মাসের শুক্ল পক্ষে অষ্টমী তিথিতে জনৈক রাজা(?) হরিশ্চন্দ্রের স্ত্রী হরিপ্রিয়া তাঁদের ইষ্টদেবতা শিবের উদ্দেশ্যে এই মন্দির নির্মাণ করেন। তৃতীয় মন্দিরের শিলালিপি অনুসারে ১৪৬৮ শকাব্দে(১৫৪৬ খ্রিস্টাব্দে) জনৈক ব্রাহ্মণ নন্দ এবং তাঁর স্ত্রী এই মন্দিরটি সংস্কার করেছেন। অর্থাৎ মন্দিরটি আরও আগে নির্মিত। সঙ্গে আনা কম্পাস দেখাচ্ছে তৃতীয় মন্দিরটি পশ্চিমমুখী, বাকিগুলো সব পুবমুখী।

বেগুনিয়া নামটি শুনে হয়তো একটু কৌতূহল হচ্ছে - এই নামের অর্থ কী? ওড়িশা শৈলীর এই মন্দিরগুলির শিখরের আকৃতির সঙ্গে অনেকাংশে আধকাটা বেগুনের সাদৃশ্য আছে বলে এই জায়গার নাম বেগুনিয়ার মন্দির। খোদ ওড়িশাতেও এরকম একটি দেউল গ্রামের নাম বেগুনিয়া।
প্রতিটি মন্দির গাত্রে অসম্ভব সুন্দর সুন্দর সব পাথরের মূর্তি - যথা উড়ন্ত সিংহ, মকর, রাক্ষসের মতন কীর্তিমুখ(যা শিব মন্দিরের বিশেষত্ব। স্কন্ধ পুরাণে বলা হয়েছে, শিবের আদেশে জলন্ধর রাক্ষস নিজের শরীরকে নিজে গিলে ফেললে, শিব তার নাম নাম দেন- কীর্তিমুখ বা face of glory.)
এ ছাড়াও বিভিন্ন দেবদেবী - অনন্তশয্যায় বিষ্ণু, অসংখ্য মৎসকন্যা আছে মন্দির জুড়ে।
চতুর্থ মন্দিরের আরাধ্য দেবতা সিদ্ধেশ্বর শিবের নামেই এই মন্দিররাজির নাম সিদ্ধেশ্বর মন্দির। এই ছোট মন্দিরটি বাংলার সর্বপ্রথম দেউল এবং সম্ভবত অষ্টম শতকে নির্মিত। প্রথম মন্দিরে তিনটি শিবলিঙ্গ ও কালী মূর্তি, দ্বিতীয়টিতে তিনটি শিবলিঙ্গ ও গনেশ মূর্তি, তৃতীয় মন্দিরটিতে পাঁচটি শিবলিঙ্গ ও একটি পাথরের মাছ দেখা যায়। মাছ বা মীন সম্ভবত নারী শক্তির প্রতীক। J.D.Beglar সাহেব লিখেছেন- The sculpture represents a fish 5 ft.9 inches long from snout to the tip of the tail, 2ft.3 inches wide at the swell below the head and 1ft. 9inches at the junction of the tail. The tail itself is 9 inches long by 2 feet 1 inch wide at its extremity.

পাথরের তৈরি দেউল মন্দির পশ্চিমবঙ্গে বিরল। অলংকরণ, আকার, নান্দনিকতা দিয়ে বিচার করলে একমাত্র পুরুলিয়ার বান্দার দেউল এর সঙ্গেই বেগুনিয়ার মন্দিরের তুলনা করা যায়।
চতুর্থ মন্দিরটি নিয়ে কিছু বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। আগেই বলেছি রেখা বা শিখর দেউল এর সর্ব প্রাচীন উদাহরণ এটি। নিচু ভিতের ওপর উঁচু গর্ভগৃহ। গোড়া থেকেই শিখরের ক্রমবক্র রেখা উর্দ্ধে উঠে গেছে। শিখরের পগ রেখাগুলি যেন অসংখ্য লোহার পাতের মতন মন্দিরকে বেষ্টন করে আছে। শিখরের উপর একটি বৃহৎ আমলক শিলা(গোল চাকতির মতন খাঁজ কাটা)। স্থাপত্যের দিক দিয়ে এই মন্দিরটি ভুবনেশ্বরের পরশুরামেস্বর মন্দিরের সমকালীন, অর্থাৎ অষ্টম শতকে তৈরি। (মন্দির স্থাপত্য-১৪,শিল্পকলা- বাংলা লাইব্রেরি) পরশুরামেস্বর মন্দিরে বিমানের সঙ্গে যুক্ত আছে জগমোহন, যা এই মন্দিরে নেই। এছাড়া ওড়িশার রেখা দেউল-এর মন্দিরগুলির আমলক হয় 'convex', কিন্তু বরাকর মন্দিরের আমলক গুলি concave.(বিনয় ঘোষ, পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি)।

তাহলেই বুঝুন, কী চমৎকার এবং ঐতিহাসিক মূল্যের স্থাপত্য আমাদের বাংলায় আছে যার সম্মন্ধে আমরা উদাসীন, কোনো খোঁজও রাখি না।