দুই বাংলার মিলন ভবা পাগলার সুরে

‘বারে বারে আর আসা হবে না’ কিংবা ‘এখনও সে রাধারানি, বাঁশির সুরে পাগলিনী, এখনও সেই বৃন্দাবনে বাঁশি বাজে রে’ — খুবই জনপ্রিয় সব লোকসংগীত। কিন্তু আদতে এটি কার লেখা, তা হয়তো অনেকেই জানেন না। ভবা পাগলা। যে নামের আড়ালে লুকিয়ে আছে ভবেন্দ্র মোহন সাহা। উনিশ শতকে জন্ম। পাতলা গড়ন, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ রং, ঝাঁকড়া চুল, থুতনিতে একগোছা দাড়ি — এই নিয়েই দিব্যি ছিলেন ভবা পাগলা। নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে লিখছেন,
“পূর্ববঙ্গের ঢাকার গর্ভে গর্বিত গ্রাম আমতা
সেই গাঁয়ে জনম মোর, পিতা গজেন্দ্র, গয়ামাতা
বাঁচন মরণ এই দুই কূল, সমাজ অমর ধাম
সেই সমাজের অধিকারী মুই, ভবা পাগলা মোর নাম”
কিন্তু ভবার গান আজ বিস্মৃতপ্রায়। দুই বাংলা কার্যত ভুলতে বসেছে তাঁর সৃষ্ট সুরকে। সুর বিকৃতি তো আছেই। পথে-ঘাটে চলতে ফিরতে ভবা গান বাঁধতেন মুখে মুখে। মাথাতেই চলত কথা, পথেই তৈরি হয়ে যেত সুর। অনেক গানই সংরক্ষণ করা তাই সম্ভবও হয়নি৷ যদিও বিভিন্ন গবেষণা বলছে, ভবা পাগলার গানের সংখ্যা প্রায় দশ হাজার। যদিও দু-চারটি গান ছাড়া কেউই আর অন্যান্য গানগুলি মনে রাখেনি। জাত-পাত আবার কী! সবাই অন্তর থেকে আসলে এক। আজীবন এই মন্ত্রে বিশ্বাস করে এসেছেন। তাঁর গানেই আছে, “দূর করে দে মনের ময়লা”। ভবার গানে রয়েছে বিষাদের ঝংকার, অভিমানের একাকিত্ব। যিনি গঙ্গা আর পদ্মাকে এক সুতোয় গেঁথে দিতে পারেন অনায়াসে।
ভবার শেষ জীবনটা ছিল অদ্ভুত। মানুষজন তাঁকে ঈশ্বরজ্ঞানে পুজো করতে থাকেন। এর পিছনে যদিও একটা কারণ আছে। নন্দলাল দাস নামের এক ব্যক্তিকে দুরারোগ্য রোগ থেকে ঘটনাচক্রে সারিয়ে তোলেন। এরপরেই ভবাকে ঈশ্বরজ্ঞানে পুজো করা শুরু হয়৷ তৈরি হয় ভবার হরবোলা মন্দির।
অধ্যাপক উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ‘বাংলার বাউল ও বাউল গানে’ বইয়ে ভবার দুটি গান ছেপেছিলেন। মুহাম্মদ মনসুর উদ্দিন ‘হারামণির সপ্তম খণ্ডে’ ভবা পাগলা সম্পর্কে লিখেছেন, “ভবা পাগলা একজন নামকরা বাউল গান রচয়িতা। সাটুরিয়া থানার (বর্তমানে উপজেলা) অন্তর্গত আমতা গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। স্বাধীনতার পর (অর্থাৎ ১৯৪৭-এর পর ১৯৭১ সালে) তিনি বাংলাদেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে যান। তাঁর গান মানিকগঞ্জ জেলা সহ বাংলাদেশ ও ভারতে বিভিন্ন স্থানে পরিচিতি লাভ করে ও গীত হয়ে আসছে। তিনি মূলত শ্যামা সংগীত, ভাব গান, গুরুতত্ত্বের গান, দেহতত্ত্বের গান, ও সৃষ্টিতত্ত্বের গান রচনা এবং সুর নিজেই করেছেন। তিনি ১৯৪৭-এ ভারতে চলে যান এবং বর্ধমানে কালনাতে অবস্থান করতেন। ভবা পাগলা ১৯৮৪ খৃস্টাব্দে দেহ ত্যাগ করেন।”শোনা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়েও গান লিখেছিলেন ভবা। যে গানে রয়েছে নদীমাতৃক বাংলাদেশের বর্ণনা এবং বহির্শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য দেশের নাগরিকদের প্রতিবাদী ভূমিকায় জেগে ওঠার আহ্বান। পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-ব্রহ্মপুত্রের বন্দনা করা এই গানে রয়েছে—
“(আজি) পদ্মার জল লাল
যমুনার জল কালো
ব্রহ্মপুত্র অতীব ভীষণ, মেঘনা নদী অতি বিশাল”
এছাড়াও উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ‘বাংলার বাউল ও বাউল গানে’ বইয়ে দুটি গানের কথা উল্লেখ আছে।
১। এমন মানব জনম আর পাবেনা
বারে বারে আর আসা হবে না।।
তুমি যাহা করে গেলে আসিয়া হেথায়
চিত্র গুপ্ত লিখিল খাতায়
হিসাব করিবে সেই বিধাতায়
তাঁর কাছে ফাকি-জুকি কিছুই চলেনা।।
সাবধানে চলো মন হও হুশিয়ার
তোমার বেলা যে বয়ে যায় আসে অন্ধকার।।
জুড়িয়া রয়েছে হৃদয় আকাশ
ভবা কহে চোখ মেলে চেয়ে দেখোনা।।
এবং
২। ওরে মানুষ, দেখবি যদি ভগবান।
ছেড়েদে তোর হিংসা বৃত্তি
ঐইত বিঘ্ন অতি প্রধান।।
ছেড়েদে তোর ভিন্ন বেধ
দেখনা শাস্ত্র দেখনা বেদ।।
বাইবেল কোরআন নয়রে প্রভেদ
শোনরে হিন্দু শোন মুসলমান
ভিন্ন নয়রে আল্লা-হরি
শোনরে ফকির ব্রহ্মচারী ।।
দেখতে তাঁরে হয়না দেরি
সপেদে তোর হৃদয় প্রান
কিবা মসজিদ কিবা মন্দির
সাতটি ফোটা যেমন বন্দি।।
বাইরে আয়রে দেখরে সন্ধি
উড়ছে নিশান বিশ্বখান
ভবা পাগলা কইবে কত
সবাইর পদে হয় সে নত।।
দেখনা ভেবে শত শত
আসা যাওয়া একই সমান।
বাংলা লোকসংগীত যতদিন থাকবে ভবা পাগলার গানও থাকবে স্বমহিমায়৷ জাত-পাত রোধে এই গানগুলিই হয়ে উঠবে শ্রেষ্ঠ অস্ত্র।
তথ্যসূত্রঃ
সামিউল ইসলাম, বাংলাদেশের লোকসঙ্গীতের শ্রেনিবিন্যাস, বাংলা একাডেমি
এবং
‘বাংলার বাউল ও বাউল গানে’, উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য