দুর্গাপুজোর প্রাক্কালে শহরে রাবেয়া, আসমা, শম্পাদের নকশি কাঁথার প্রদর্শনী

এই নকশি কাঁথাটির মূল্য ২৫০০০ টাকা । ৭ মাস লেগেছে বানাতে
এবিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, কবি জসীমুদ্দিনের ‘নকশি কাঁথার মাঠ’ জনমানসে বিপুল জনপ্রিয় করে তুলেছিল জিআই (Geographical Indications) তকমা পাওয়া এই সূচীশিল্পটিকে। কিন্তু সাহিত্যের বাইরে বেরিয়ে অধুনা ক’জনই বা ‘নকশি কাঁথা’-র (Nakshi Kantha) খোঁজ রাখে? দুহাজার বছরেরও বেশি পুরোনো এই বিশিষ্ট শিল্পশৈলীটি ভারতীয় উপমহাদেশের নানা অঞ্চলে দেখা গেলেও, বাঙালির সংস্কৃতিবলয়ে এর প্রকাশ ঘটেছে এক অনন্য নিজস্বতায়। দুর্জনি থেকে জায়নামাজ, আর্শিলতা থেকে বাতায়ন, খিচা থেকে সুজনি—বহু বিচিত্র আকারে এবং নামে তার পরিচিতি। রানফোঁড়, ডালফোঁড়, ক্রশফোঁড়, বেঁকিফোঁড়, জালিফোঁড়—সুচসুতোর নানান কারুকৃতিতে তার উদ্ভাস। বাংলার মেয়েরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে, প্রীতি-অনুরাগ দিয়ে এই শিল্পকলাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। ১৫ থেকে ১৮ সেপ্টেম্বর সেসবেরই প্রদর্শনী হয়ে গেল গগনেন্দ্র শিল্প প্রদর্শশালায় (Gaganendra Shilpa Pradarshanshala)। ‘বাংলার নকশি কাঁথা’ (Banglar Nakshi Kantha) শীর্ষক এই প্রদর্শনীটির আয়োজন করেছিল রাজ্য লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ।
সংস্কৃত শব্দ ‘কন্থা’ থেকে উদ্ভুত কাঁথা শব্দের অর্থ জীর্ণবস্ত্র রচিত আস্তরণ বা শীতবস্ত্র বিশেষ। গাছের নীচে দু’টি হরিণ আর নীচে লেখা “সোনার হরিণ কোন বনেতে থাকো?” বা কয়েকটি ফুলের ছবির সঙ্গে “সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে”— এমন সব ছবি ও কথা লেখা হত কাপড়ের উপর রঙিন সুতো বুনে। কোনও কোনও বাড়িতে আবার এই ধরনের শিল্পকর্ম ফটোর আকারে কাচের ফ্রেমে বাঁধিয়ে দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখাও হত। একান্নবর্তী পরিবারে বড় হয়ে ওঠা মানুষজনের স্মৃতিতে এখনও উজ্জ্বল, সেই সব দিনে মা-পিসিমাদের শখ হিসেবে থাকা এই শিল্পকর্মের কথা।
কিন্তু বর্তমানে কাঁথা শিল্প মৃতপ্রায়। শহুরে জীবনে কাঁথার কদর নেই। একটি নকশি কাঁথা তৈরি করতে এক জন কাঁথাশিল্পীর যে পরিমাণ পরিশ্রম হয়, সেই পরিমাণ মজুরি তাঁরা পান না। একটি ঝাড়ফুল বা আঙুরখোপা কাঁথার মূল্য এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা। কাঁথার জন্য এত খরচ করতে অনেকেই বিমুখ। এ ছাড়া সস্তা, অত্যাধুনিক কম্বলে বাজার এতটাই ছেয়ে গিয়েছে যে প্রতিযোগিতায় কাঁথার টিকে থাকা মুশকিল।
কাঁথা সেলাইয়ের আশ্চর্য ভান্ডার নিয়ে গগনেন্দ্র শিল্প প্রদর্শশালায় আয়োজিত এই প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছিলেন বর্ধমানের নূরজাহান বিবি, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার আসমা সুলতানা, বীরভূমের রাফেয়া বিবি, মমতাজ বিবি, নদিয়ার হাবিবা মণ্ডল, বহরমপুর মুর্শিদাবাদ থেকে বিলকিস রাবেয়া, পশ্চিম বর্ধমানের শম্পা মজুমদার। সমস্ত জেলারই আলাদা আলাদা নকশা, গল্পের ফোঁড়। গ্রাম, রাঙা মাটি, গরুর গাড়ি, পুরাণ, সমসাময়িক সমাজ সবটাই সুচসুতোর সূক্ষতায় ধরা পড়ে।
শুধু কাঁথা নয়, বিছানার চাদর, ব্যাগ, ডাইরি, টেবিল ক্লথ, উত্তরীয়, অন্যান্য পোশাক পরিচ্ছেদও কাঁথা সেলাইয়ের ছোঁয়ায় অনন্য করে তুলেছেন তাঁরা। তবে নকশি কাঁথার কথা আলাদা। সময় ও পরিশ্রম অনুযায়ী দামও বেশি। কোনোটির দাম ১৫০০, কোনওটি ২৫০০, কোনোটি আবার ২৫০০০। লাখ টাকার নকশাও আছে। কারো কারো জন্য এই শিল্পসামগ্রীগুলি কেনা সাধ্যাতীত হলেও এহেন শিল্পকর্ম তো আসলেই ‘অমূল্য’।
গ্রামীণ মহিলাদের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে কাঁথা-শিল্প কতখানি ভূমিকা রাখতে পারে, এরকম একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করে তা বুঝিয়ে দিয়েছে রাজ্য সরকার। নদিয়ার হাবিবা মণ্ডল বলছিলেন, “বাজারে যন্ত্রের তৈরি কাঁথার দাম অনেক কম। তা কিনতেই ক্রেতার আগ্রহ বেশি। তাই এখন বরাত মেলে না। ফলে কাঁথা তৈরি করে উপার্জন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সরকারি সাহায্য ছাড়া এই শিল্পকে বাঁচানো যাবে না। তবে, সেই সাহায্য ধীরে ধীরে পাচ্ছি আমরা। রাজ্য সরকারের তরফে এই ধরনের প্রদর্শনীর আয়োজন হওয়াতে নকশি কাঁথা নিয়ে আবার নতুন করে মানুষের আগ্রহ বাড়ছে।”
দুর্গাপুজোর প্রাক্কালে প্রদর্শনী থেকে কেমন বিক্রিবাট্টা হল? পশ্চিম বর্ধমানের শম্পা মজুমদারের কথায়, “অন্যান্য শিল্পসামগ্রীর তুলনায় কাঁথাশিল্পের দাম অনেকটাই বেশি, তাই প্রচুর বিক্রি হবে এ আশা করি না। তবে, দুর্গাপুজোর আবহে ভালোই হল প্রদর্শনী। প্রচুর মানুষ এলেন, আমার কাজ দেখলেন, কেউ কেউ কেনেননি এমনটাও নয়। এটুকুই পাওয়া।”
ছবি নিজস্ব