‘মুখোশ’-এর আড়ালে রয়েছে বাংলার প্রাচীন শিল্পকলার ঐতিহ্য

মুখোশের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ আজকের নয়। সুপ্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠান এবং সাংস্কৃতিক আয়োজনে মুখোশ ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ১৫৩০-এর দশকে মধ্য ফরাসি শব্দ ‘মাস্ক’ থেকে ইংরেজিতে প্রথম মুখোশ শব্দটি আসে। যার অর্থ ‘মুখ লুকিয়ে রাখা বা পাহারা দেওয়ার জন্য ঢেকে রাখা’। এই ফরাসি শব্দ ‘মাস্ক’ উদ্ভুত হয়েছে ইতালীয় ‘মাশচেরা’ থেকে,যা মধ্যযুগীয় লাতিন ‘মাসকা’ থেকে এসেছে। এর অর্থ হল ‘মুখোশ, ভূত, দুঃস্বপ্ন’।
কাঠের মুখোশ তৈরির ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় গামা এবং ছাতিম গাছের কাণ্ড। এইসব মুখোশগুলি হালকা ওজনের হয় তবে খোদাই করার সময় ভেঙে যায় না। এছাড়াও শিমুল, শিশু, আম এবং জাম গাছের কাণ্ডও ব্যবহার করা হয় মুখোশ তৈরিতে।
অতি প্রাচীনকাল থেকে সারা বিশ্বের মানুষ বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে মুখোশের ব্যবহার করে আসছে। এক এক ধরনের মুখোশের মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে এক এক রকমের বৈশিষ্ট্য। শুধু তাই নয়, মুখোশগুলি প্রতি ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র রূপও বিকাশ করে। পাশাপাশি জাদুর খেলা এবং ধর্মীয় কাজেও ব্যবহৃত হয় মুখোশ। এছাড়াও মঞ্চাভিনয়ের ক্ষেত্রে প্রসাধনী হিসেবে বহুল চাহিদা রয়েছে মুখোশের। তবে মুখোশের অর্থ আরও বেশি গুরুত্ব পায় যখন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সমাজের তথাকথিত রক্ষকেরা অদৃশ্য মুখোশ বা ছদ্মবেশ ধারণ করেন। এছাড়া মুখোশগুলি সুরক্ষার কাজে, শিকারের ক্ষেত্রে, বিভিন্ন খেলাধুলায়, পিকনিকে, যুদ্ধে অথবা কেবলমাত্র সাজের অলঙ্করণ হিসাবেও ব্যবহার করা যেতে পারে।
পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন ধরনের মুখোশ তৈরি হয়। সাধারণত মাটি, কাঠ, বাঁশ এবং কাগজই হল এ সমস্ত মুখোশ তৈরির মূল উপকরণ। উত্তর দিনাজপুর জেলায় মুখোশ তৈরিতে ব্যবহার কোড়া হয় কাঠ এবং সোলা (মূলত মটর জাতীয় লতানো গাছের ডালপালা দিয়ে মুখোশের বিভিন্ন প্রয়োজনীয় উপকরণ তৈরি করা হয়)। কাঠের মুখোশ তৈরির ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় গামা এবং ছাতিম গাছের কাণ্ড। এইসব মুখোশগুলি হালকা ওজনের হয় তবে খোদাই করার সময় ভেঙে যায় না। এছাড়াও শিমুল, শিশু, আম এবং জাম গাছের কাণ্ডও ব্যবহার করা হয় মুখোশ তৈরিতে।
মুখোশ তৈরির প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল। সদ্য কাটা গাছের কাঠই ব্যবহার করতে হয় মুখোশের জন্য। প্রথমে প্রায় ৫০ সেন্টিমিটার লম্বা এবং ৯০ সেমি পরিধি বিশিষ্ট কাঠের ব্লকগুলিকে মাঝখান থেকে দু-ভাগে ভাগ করা হয়। এরপর কাঠের বাইরের রুক্ষ দিকে খোদাই করা হয় মুখের অবয়ব। বিভিন্ন আকার ও আকৃতির ছেনি, গজ এবং ছুড়ির সাহায্যে অসাধারণ দক্ষতায় কান, নাক, দাঁতের ভাস্কর্য করা হয়। এরপর মুখোশটি মুখের সঙ্গে বাঁধার জন্য তিনটি ছোটো গর্ত তৈরি করা হয়। দুটি কানের পাশে এবং একটি মুখোশের উপরে। এছাড়াও অভিনয়শিল্পীদের সুবিধার্থে চোখ এবং নাকের জায়গায় খোদাই করে ফাঁকা রাখা হয়, যাতে তারা তাদের অভিনয়ের সময় দেখতে এবং শ্বাস নিতে পারেন। খোদাই-এর কাজ শেষ হলে, মুখোশের পৃষ্ঠটি ‘স্যান্ড পেপার’ দিয়ে ঘষে মসৃণ করা হয়। অবশেষে তুলির টানে তেল রং দিয়ে সাজানো হয় মুখোশগুলি।
অভিনয় অথবা নাচের ক্ষেত্রে সচারচর শোলার মুখোশ ব্যবহার করা হয় না। মূলত ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের জন্যই তৈরি করা হয় এ ধরনের মুখোশ। এই মুখোশগুলি খুবই ঝলমলে এবং রঙিন হয়। বিভিন্ন জলাভূমি থেকে সংগ্রহ করা হয় শোলা। প্রথমে শোলা থেকে শাঁস বের করা হয়। তারপর লম্বা লম্বা টুকরো করে কেটে কাগজের ওপর আঠা দিয়ে আটকে তৈরি করা হয় বিভিন্ন আকারের মুখোশ। সব শেষে বাজার চলতি রং চাপানো হয় শোলার মুখোশগুলিতে। বৈশাখ-জৈষ্ঠ (এপ্রিল-জুন) মাসে নানান পুজোর আচার-অনুষ্ঠানে, শোলার তৈরি মশান ও কালির মুখোশ ব্যবহার করা হয়।
মূল প্রতিবেদনটি ইংরেজিতে পড়তে এখানে ক্লিক করুন।