বেঙ্গল ল্যাম্প এক সময় ভালোই চাপে ফেলেছিল বিদেশি কোম্পানি ফিলিপ্সকে

স্টপেজটা আজও আছে। যাদবপুর এইটবি বাসস্ট্যান্ড পেরোলেই কন্ডাকটর হাঁক দিতে থাকে “বেঙ্গল ল্যাম্প! বেঙ্গল ল্যাম্প”... কোথায় আর সেই বাতিদান? নামটা থেকে গেছে, এই যা। অথচ বিদেশি ফিলিপ্স কোম্পানিকে একসময় ভালোই চাপে ফেলেছিল বেঙ্গল ল্যাম্প। সেই আলোয় কলকাতা তো সেজেছিলই, সেই ঔজ্জ্বল্য পৌঁছে গিয়েছিল প্রতিবেশী রাজ্যেও। বিশ শতকের প্রথমার্ধে যে সব নিত্যনতুন উদ্যোগ গড়ে উঠেছিল, তারমধ্যে অন্যতম ছিল যাদবপুরের এই কারখানা।
আরও পড়ুন
ঘোড়ার গাড়িই একসময়ের ফ্যাশান ছিল কলকাতায়
কলকাতা এমনিতে চিরকালই নস্টালজিয়ায় ভোগা শহর। মৌসুমি ভৌমিকের গান আছে না, ‘কিছু ফেলতে পারি না...’, কলকাতারও এমন একটা স্বভাবদোষ আছে। নইলে কলকাতায় যখন ‘রাতটাকে সে দিন করে দেয়’ – এমন বিজলিবাতি হানা দিল – কলকাতাবাসী তখন রইল দিব্বি মুখ ফিরিয়ে। তার দু-চোখে তখনও গ্যাসের আলোর মায়া। সেই প্রেম থেকে কিছুতেই সে বেরোচ্ছে না। ১৯০৪ সালে ইউরোপে প্রথম টাংস্টেন ফিলামেন্টযুক্ত বিশাল বালব আবিষ্কৃত হয়। কিছুদিনের মধ্যে কলকাতাতেও তার আমদানি। অত আলো দেখেও কলকাতাবাসী কিন্তু সেদিকে ঝাঁপ দিল না। সিইএসসি নাকি উঠে-পড়ে লেগেছিল শহরের মানুষকে বিজলিবাতির নেশা ধরাতে। কিন্তু কিছুতেই বেমক্কা আলো শহরবাসী মেনে নেয়নি। গ্যাসের মৃদু তিরিতিরি কাঁপনের আলোকশিখা তখনো কবিতা লেখার ভাব জোগায়। ১৯১৬ সালে নাকি চৌরঙ্গীতে রাস্তার দু’ধার জুড়ে প্রথম বিজলি আলোর ঝলকানি দেখা গিয়েছিল। যাই হোক, অসম লড়াইয়ে শেষমেশ গ্যাসের আলো বিদায় নেয়। ১৯৩০-৪১ সালে ফিলিপ্স ইলেকট্রিক কোম্পানি (ইন্ডিয়া) ৩২ নম্বর চৌরঙ্গী রোডে ৭৫ জন অফিসার কর্মচারীসহ অফিস প্রতিষ্ঠা করে। আর ঠিক একই সময় কলকাতার কসবা অঞ্চলে গুটিগুটি পায়ে জন্ম নেয় বেঙ্গল ল্যাম্প।
তিনজন বাঙালি যুবক জার্মানি থেকে আমদানি করেন বিদ্যুৎবাতি তৈরির যন্ত্রপাতি। তিন যুবক আসলে তিন ভাই। বড়ো ভাই সুরেন রায় এবং সেজো ভাই কিরণ রায় ছিলেন ইলেকট্রিক্যাল এঞ্জিনিয়ার। যাদবপুরে তাঁরা অধ্যাপনাও করতেন। আর মেজো ভাই হেমেন রায় ছিলেন দক্ষ প্রশাসক। ঢাকার নরসিন্দার জমিদার পরিবারের সন্তান এঁরা। বিদ্যাবুদ্ধি কোনোকিছুই তাঁদের কম ছিল না। প্রথম কয়েকবছর টাংস্টেন ফিলামেন্ট ল্যাম্প তৈরি করেন তাঁরা। ফিলিপ্সের সোডিয়াম-মার্কারির জোরালো আলো তখনও অন্দরমহলের পক্ষে ছিল বেমানান। আর যুগটাও স্বদেশি। বেঙ্গল ল্যাম্প – নামেই যেন হিট করে গিয়েছিল। ফিলিপ্সকে পিছনে ফেলে বাংলার ঘর আলো করে বসল বাঙালি ছেলের তৈরি আলো। ব্যাস, আর দেখে কে? ঘরে ঘরে বেঙ্গল ল্যাম্প। কারখানাতেও প্রচুর তরুণ বাঙালি যুবক ভিড় করতে লাগল। তাদের হাতে হাতেই কলকাতা আলোকিত হতে শুরু করল তখন।
১৯৪৭। স্বাধীনতা। বেঙ্গল ল্যাম্প তখনো তুঙ্গে। তাই কসবা ছেড়ে আরো বড়ো কারখানা তৈরি হল যাদবপুরে। পরে বাংলার আলো পৌঁছে গেল ব্যাঙ্গালোরেও। সেখানেও সোডিয়াম ল্যাম্প, মার্কারি ল্যাম্প বাজার গুছিয়ে বসল। ১৯৬০-এর দশকে। বেঙ্গল ল্যাম্প তখন সর্বভারতীয়।
গল্পের শেষটায় অবশ্য বিচ্ছেদ। বড়ো ভাইয়ের সঙ্গে সেজো ভাইয়ের। ফলশ্রুতি বেহালায় নতুনভাবে তৈরি হয় ‘কিরণ ল্যাম্প ‘।
যা হোক, যাদবপুরে একসময়ে দাপিয়ে বেড়ানো বাতিদান আজ শুধুই একটি নামমাত্র। সেই আলো আর নেই। আমরা শেষমেশ নিজস্ব আলোগুলো এভাবেই ছেড়ে দিয়ে থাকি। তাও যদ্দিন নামটুকু আছে, তদ্দিন অতীত খুঁড়ে তোলার চেষ্টাও থাকতে পারে। সেটুকুও যদি বদলে যায়... তাহলেই “আলোহীনতায় ডুবে নিস্তব্ধ নিস্তেল...”।