No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    বেলতলা গার্লস হাইস্কুল : মেয়েদের শিক্ষা, চেতনা ও প্রগতির আরেক নাম

    বেলতলা গার্লস হাইস্কুল : মেয়েদের শিক্ষা, চেতনা ও প্রগতির আরেক নাম

    ক্ষিণ কলকাতার শতবর্ষীয় প্রাচীন শিক্ষাঙ্গন বেলতলা গার্লস হাইস্কুল-এ (Beltala Girls High School) সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল ২০২২-২৩ বর্ষের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান, বিদ্যালয়ের তরফ থেকে যেটিকে বলা হচ্ছে শতবর্ষ উদযাপনের সমাপ্তি অনুষ্ঠানের সূচনা। এদিন উপস্থিত ছিলেন এই বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্যারিমোহন চট্টোপাধ্যায়-এর (Late Peary Mohan Chatterjee) পরিবার। প্রধান শিক্ষিকার সহায়তায় শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করার জন্য বৃত্তি ও অলরাউন্ডার ট্রফি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল এদিনের অনুষ্ঠানে।

    উনিশ শতকের বঙ্গ সমাজে কিছু বাঙালি আপাত অন্ধবিশ্বাস ঝেড়ে ফেলে মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে থাকল। ধীরে ধীরে ঘোচানোর চেষ্টা হল পর্দার আড়াল। হেঁশেল সামলেও সমানতালে যে বাইরের কাজ করা যায়, তার প্রমাণ দিতে থাকল। শুরু হল মেয়েদের ঘর ছেড়ে বাইরে বেরনোর লড়াই। অন্তঃপুরবাসিনীরা নিজেরাই নিজেদের জীবনে নিয়ে এলেন আলোর উৎস। ঠিক এমনই এক মাহেন্দ্রক্ষণে বাংলার নবজাগরণের প্রতীক হিসাবে কলকাতায় জন্ম নিল প্রথম মেয়েদের স্কুল – বেথুন। তারপর ধীরে ধীরে ইতিউতি মেয়েদের স্কুল নির্মিত হল বটে, কিন্তু বেশিরভাগই খ্রীষ্ট বা ব্রাহ্মধর্মকে গুরুত্ব দিয়ে।

    কলকাতার দক্ষিণাঞ্চল সেই শুরুর দিন থেকেই বর্ধিষ্ণু। সেখানে বাংলা মাধ্যমের ভালো বিদ্যালয় প্রায় নেই বললেই চলে। বিশেষ করে সাধারণ নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়েদের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থাও ছিল না। এমনই এক সংকটজনক পরিস্থিতিতে আইনজীবী প্যারিমোহন চট্টোপাধ্যায়ের ভাবনায় হাজরা অঞ্চলে নির্মিত হল একটি স্কুল, যা আজ বেলতলা গার্লস হাইস্কুল নামে পরিচিত। আজ থেকে ১০৪ বছর আগে ১৯২০ সালের ২ জুলাই, মাত্র ছয়জন মেয়েকে নিয়ে প্যারিমোহনবাবু তাঁর লাইব্রেরিতেই একটি বালিকা বিদ্যালয় শুরু করেন। ১০৪ বছর আগে মেয়েদের শিক্ষার অগ্রাধিকার ছিল না। সেই সংকীর্ণ সমাজব্যবস্থার বাইরে বেরিয়ে আধুনিক মনস্ক এবং স্বাধীনচেতা প্যারিমোহন দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। এক বছর পর বিদ্যালয় নির্মাণের জন্য নিজের বাড়ি বন্ধক রাখলেন। ঔপনিবেশিক বাংলায় সমাজের সর্বস্তরের মেয়েদের স্বাগত জানাল এই বিদ্যালয়। ১৯২২ সালে চিত্তরঞ্জন দাশ-সহ আরও কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের সহায়তায় প্যারিমোহন চট্টোপাধ্যায় বেলতলা গার্লস এডুকেশন সোসাইটি স্থাপন করলেন। সোসাইটির সভাপতি ছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ এবং সম্পাদক ছিলেন প্যারিমোহন চট্টোপাধ্যায়। তাঁদের লক্ষ্য ছিল মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা মেয়েদের জন্য উচ্চশিক্ষার প্রচার ও প্রসার ঘটানো। সেখান থেকেই জন্ম নেয় আরও এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান – সাউথ ক্যালকাটা গার্লস কলেজ।

     

    স্বর্গীয় প্যারিমোহন চ্যাটার্জীর জ্যেষ্ঠা কন্যা কনকলতাদেবীর পুত্রবধূ (অর্থাৎ প্যারিমোহনবাবুর দৌহিত্রবধূ) মিঠু ব্যানার্জী বঙ্গদর্শন.কম-কে জানান, “যখন মানুষ গোঁড়ামির বেড়া ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারেনি, সেই সময় প্যারিমোহন চ্যাটার্জীর মধ্যে এ ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে একটা বিশাল আলোড়ন চলছিল। বিংশ শতাব্দীতে যখন মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হত মাত্র আট থেকে বারো বছর বয়সের মধ্যে, সেইরকম পরিস্থিতিতে প্যারিমোহনবাবু সাধারণ মধ্যবিত্ত মেয়েদের শিক্ষার জন্য এমন একটি বিদ্যালয় স্থাপন করলেন। যেখানে মেয়েরা পড়বে তাদের মাতৃভাষা বাংলায়।”

    বেলতলা গার্লস হাইস্কুলে এই মুহূর্তে ছাত্রী সংখ্যা ১৩৪০ জন এবং শিক্ষিকার সংখ্যা ৩৫। প্রাক্তনীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মহাশ্বেতাদেবী, মঞ্জুশ্রী চাকী সরকার প্রমুখ। এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা অজন্তা মুখোপাধ্যায় বঙ্গদর্শন.কম-কে বলেন, “চারপাশের নানান ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলের মধ্যেও বেলতলা গার্লস হাইস্কুল মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এবং নারীশিক্ষার প্রচার ও প্রসারে এই স্কুল দেশের মানচিত্রে আজও উজ্জ্বল হয়ে আছে। পড়াশোনার পাশাপাশি অন্যান্য নানান বিষয়ে মেয়েরা যাতে পারদর্শী হয়ে ওঠে, তার ব্যবস্থাও এই স্কুল নিয়ে থাকে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে গেলে স্কিল ডেভেলপমেন্ট অত্যন্ত জরুরি বর্তমান সময়ে। তাই আইটি এবং ব্যাঙ্কিং-এর বিশেষ কোর্স অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে পাঠ্যক্রমে।”

    শুধুমাত্র বই পড়া বা পুঁথিগত বিদ্যা নয়, মেয়েরা নানান কাজে নিযুক্ত হবে, তৈরি করবে নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয় – এটাই এই বিদ্যালয়ের আদর্শ। বেলতলা গার্লস হাইস্কুল হয়ে উঠেছে নারী শিক্ষা, নারী চেতনা এবং নারী প্রগতির আরেক নাম।

    _______
    প্রতিবেদন ও ভিডিও সম্পাদনা: সুমন সাধু

     

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @