No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    বেলঘরিয়ায় সাবর্ণ পরিবার

    বেলঘরিয়ায় সাবর্ণ পরিবার

    Story image

    বাংলার ইতিহাসে বিখ্যাত সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের একটি শাখা বেলঘরিয়ায় বাস করতে শুরু করেন আজ থেকে প্রায় আড়াই’শ বছর আগে। সে প্রসঙ্গে আসার আগে এই বংশের ইতিহাস ফিরে দেখা প্রয়োজন –     গৌড়ের রাজা আদিশূর কাহ্নকুব্জ বা কনৌজ থেকে যে পাঁচ ব্রাহ্মণ’কে বঙ্গে নিয়ে আসেন, তাঁদের একজন হলেন বেদগর্ভ। তাঁর গোত্র সাবর্ণ। বেদগর্ভের এক সন্তান হলায়ুধ বর্ধমান জেলার গাঙ্গুর গ্রামে বসবাস শুরু করেন এবং গ্রামের নামানুযায়ী তাঁর বংশের পদবি হয় গঙ্গোপাধ্যায়। বেদগর্ভের অধঃস্তন একুশতম পুরুষ হলেন কামদেব ব্রহ্মচারী। আকবরের সেনাপতি মানসিংহ, মহারাজ প্রতাপাদিত্যের বিদ্রোহ দমনের উদ্দেশ্যে বাংলায় আসার পথে কাশীতে কামদেবের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। কামদেবের পুত্র লক্ষ্মীকান্ত রাজা প্রতাপাদিত্যের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। লক্ষ্মীকান্ত গোপনে মানসিংহের সঙ্গে যোগ দেন এবং প্রতাপাদিত্যের যুদ্ধ কৌশল ব্যক্ত করেন। এই বিশ্বাসঘাতকতার ফলে মানসিংহের কাছে প্রতাপাদিত্য পরাজিত হন। এবং লক্ষ্মীকান্ত লাভ করেন বাংলার একটি বিরাট অংশের জায়গীর এবং ‘মজুমদার’ ও ‘রায়চৌধুরী’ খেতাব। এই লক্ষ্মীকান্ত’কেই রায়চৌধুরী বংশের প্রথম পুরুষ ধরা হয়।

    লক্ষ্মীকান্ত’র সন্তান গৌরহরি নিমতা-বিরাটি অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করেন। গৌরহরি’র পৌত্রের পৌত্র নীলকান্ত রায়চৌধুরী অষ্টাদশ শতকের তৃতীয় ভাগে নিমতা থেকে বেলঘরে এসে স্বতন্ত্র বসবাস শুরু করলে তাঁর বসতবাটীর সংলগ্ন অঞ্চলটি পরিচিত হয় ‘চৌধুরীপাড়া’ নামে।

    নীলকান্ত বেলঘরিয়ার রায়চৌধুরী শাখার আদিতম পুরুষ। তাঁর আগমনকাল ১৭৫০-১৭৭৫ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে। তিনি বেলঘরে দুটি শিবমন্দির নির্মাণ করান এবং তিনটি পুকুর খনন করান। বর্তমানে একটি পুকুরই অবশিষ্ট আছে, তাও প্রকৃত আয়তনের এক-তৃতীয়াংশ মাত্র!

    বেলঘরিয়ার দ্বিতীয় প্রাচীন মন্দির হিসেবে ধরা যেতে পারে নীলকান্ত রায়চৌধুরী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত প্রায় আড়াইশো বছরের পুরোনো এই দুটি শিবমন্দির। অবস্থান বর্তমান রূপমন্দির সিনেমা হলের ঠিক দক্ষিণেই। মাটি থেকে চূড়া পর্যন্ত প্রায় কুড়ি ফুট উঁচু এই মন্দিরদুটি হল বেলঘরিয়ার সবচেয়ে উঁচু মন্দির। কথিত আছে, মন্দির সংলগ্ন তিনটি পুকুরে স্নান করে পুণ্যার্থীরা এখানে পুজো দিতেন। সাধারণ চারচালার মন্দির এবং বাহ্যিক কারুকার্য বিশেষ উল্লেখযোগ্য না হলেও সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে দুটির মধ্যে।

    সারা নিমতা জুড়েই ছিল রায়চৌধুরীদের জমিদারি। আর, যেহেতু বেলঘর একসময় নিমতারই অন্তর্গত ছিল, তাই ধরে নেয়াই যায়, প্রাচীন সে সময়ে এই অঞ্চলও তাঁদেরই অধীনে ছিল। অবশ্য উনিশ শতকেই, বেলঘরিয়ায়, তাঁদের জমিদারির সীমা এসে দাঁড়ায় বর্তমান বি.এম. ব্যানার্জি রোড থেকে রেললাইন পর্যন্ত।

    লক্ষ্মীকান্ত’র অধঃস্তন সপ্তম পুরুষ দিলীপকুমার রায়চৌধুরীর জন্ম ১৯৩০’এ। শিবমন্দির দুটির শরিকি ভাগ হয় কালীপদ রায়চৌধুরী ও শিবচন্দ্র রায়চৌধুরী – এই দু’ভাইয়ের মধ্যে, ১৯৩৯ সালে। কালীপদ’র পৌত্র দিলীপচন্দ্র। তাঁর শরিকি মন্দিরটি ১৯৯৫ সালে তিনি সংস্কার করান; কিন্তু অপরটি এখনও পড়ে আছে অযত্নে, ভগ্নপ্রায়। শিবচন্দ্রের পৌত্ররা অর্থনৈতিক দিক থেকে সমর্থ হওয়া সত্ত্বেও সংস্কারের কোনও উদ্যোগ না নেওয়ায় হতাশা বারবার ঝরে পড়েছে দিলীপবাবু’র গলায়।

    শোনা যায়, আগে নাকি শিবমন্দিরের সামনে সপ্তাহে একদিন, রবিবার হাট বসত। গরু’র গাড়ি করে নিয়ে আসা হত চাল, গুড়, ফলমূল ইত্যাদি। তবে তিনি জানান, এখন যেখানে বেলঘরিয়ার রেল বাজার(রূপমন্দিরের বিপরীতে), সেখানে আগে ডোবা ছিল। সেটা বুজিয়েই বর্তমান হাটের সৃষ্টি। দিলীপবাবু ছোটবেলায় দেখেছেন সেখানে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পাদ্রীদের দাঁড়িয়ে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করতে, লিফলেট বিলোতে। এছাড়াও জিপসি’রা আসত; ছুরি, কাঁচি প্রভৃতি মনোহারী জিনিস বিক্রি করতে, বেলঘর বাজারের কাছে। তথাকথিত রক্ষণশীল এই জনপদে অবাক হওয়ার মতোই ঘটনা!

    দিলীপবাবুর দাদা অমিয়কুমার রায়চৌধুরীর দেওয়া তথ্যের সঙ্গে অবশ্য দিলীপবাবু’র কথার খুব একটা পার্থক্য নেই। সমগ্র অনুসন্ধানে আমার সংস্পর্শে আসা অন্যতম প্রবীণ ব্যক্তি এই অমিয়কুমার রায়চৌধুরী। জন্ম ১জুন, ১৯২৫। তবে ১৯৫১ থেকেই বেলঘরিয়ার বাইরে।

    প্রায় দু’শ বছর আগে চৌধুরী পাড়ার রায়চৌধুরী পরিবারের এক শরিক তৈরি করান রত্নেশ্বর শিব মন্দির। এটি অবস্থিত বর্তমান বৈদ্যনাথ ঘোষাল রোডে। আদিতে এটি রায়চৌধুরীদের ঠাকুরদালান হিসেবে ব্যবহৃত হত। কিন্তু শরিকি অবস্থার বিপাকে অবহেলার শিকার হয় মন্দিরটি। দেড়’শ বছর আগে, নন্দলাল রায়চৌধুরী মন্দিরটির সংস্কার করান। কালো শিলায় তৈরি প্রাচীন শিবলিঙ্গটি এখনও আছে। অনেক পরে, গত শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সামনে নাটমন্দির নির্মিত হয় ও স্থাপিত হয় রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ। তখন থেকেই, মন্দিরে নিত্যপূজা ও নামগান হয়ে আসছে এবং তা আজও অম্লান।

    সূত্র –
    বেলঘরিয়ার ইতিহাস সন্ধানে – তন্ময় ভট্টাচার্য
    প্রকাশক – ‘আরশিনগর-প্রাণভূমি’
    প্রকাশকাল – ২০১৬

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @