ঋত্বিক ঘটকের বাড়ি থেকে পালিয়ে : বাংলার প্রথম পূর্ণাঙ্গ শিশু চলচ্চিত্র!

শিশু চলচ্চিত্র ব্যাপারটা আজ প্রায় বিলুপ্ত একটা বিষয়। বিশেষ করে বাংলা সিনেমার নিরিখে বলতে গেলে, পূর্ণাঙ্গ শিশু চলচ্চিত্র হিসাবে শেষ ভালো কাজ হল, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে, পাতালঘর (২০০৩) বা নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্প “পঞ্চাননের হাতি” অবলম্বনে দামু (১৯৯৬)। যদিও পাতালঘর বা দামুর আগেও একটা লম্বা তালিকা আছে। সেই সমস্ত শিশু চলচ্চিত্রগুলো ৫০ ও ৬০-এর দশকের গুরুত্বপূর্ণ পরিচালকদের কীর্তি। সেই দক্ষ ছবিগুলোর মধ্যে গুপী গাইন বাঘা বাইন (১৯৬৯), সোনার কেল্লা (১৯৭১), শ্রীমান পৃথ্বীরাজ (১৯৭২), হীরক রাজার দেশে (১৯৮০) বা বালিকা বধূ (১৯৬৭) নিয়ে বাঙালির যে মাতামাতি, তা এই তালিকার প্রথম ছবিটার প্রতি ঠিক ততটা নয়। ঋত্বিক ঘটকের ছবি বাড়ি থেকে পালিয়ে (১৯৫৮)।
বাড়ি থেকে পালিয়ে (Bari Theke Paliye / Runaway)-র আগে কেউ বোধ করি ভেবে দেখেননি, যে শিশুদের জন্য ছবি বানালে তার ভাষা কেমন হবে বা একজন শিশুর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কীভাবে একটি ছবির নির্মাণ হতে পারে। এই লেখায় তাই মূলত কথা বলবো যে কীভাবে এই ছবি শিশু চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে একটা জরুরি মাইল ফলক এবং সেই ন্যারেটিভ নির্মাণের ক্ষেত্রে পরিচালক ঋত্বিক ঘটক যে ভাবে শহর কলকাতাকে ও তার কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্যকে ব্যবহার করে এক জটিল মনস্তত্বের দিকে ছবিটিকে নিয়ে যান। অন্যদিকে, শিশু চলচ্চিত্র হওয়া সত্ত্বেও যেভাবে জাতপাতের সমস্যা এই ছবির আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে। এছাড়াও যে বিষয় নিয়ে আলোচনা না করলে এই লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, তা হল এই ছবির আবহে সলিল চৌধুরীর সংগীত।
বাড়ি থেকে পালিয়ে নিয়ে কথা বলার আগে, একটু বোঝা যাক শিশু চলচ্চিত্র আসলে কাকে বলে! অনেকেই বলতে পারেন, যে ঋত্বিক ঘটকের বাড়ি থেকে পালিয়ে-র আগে পথের পাঁচালির মতো ছবি তৈরি হয়ে গেছে, কাজেই বাড়ি থেকে পালিয়ে কীভাবে বাংলার প্রথম শিশু চলচ্চিত্র হতে পারে! এখানে বলতে হয়, পথের পাঁচালির ন্যারেটিভের কেন্দ্রবিন্দুতে কিন্তু দুজন শিশু নয়, বরং গোটা পরিবারটাই সেখানে গুরুত্বপূর্ণ এবং তারই অম্লমধুর সু-দুঃখের অংশীদার হতে থাকে অপু আর দুর্গা। কিন্তু বাড়ি থেকে পালিয়ে-র মূল কেন্দ্রবিন্দুতেই ছিল কাঞ্চন নামক বছর দশেকের একটি ছেলের ও তার গ্রামের বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাবার গল্প। এই ভাবনা বাড়ি থেকে পালিয়ে-র আগে কোনো বাংলা সিনেমাতে উঠে আসেনি, যেখানে গল্পের মূল চালিকা শক্তিই হবে একজন বছর দশেকের শিশু। সে ভাবে দেখলে শুধুমাত্র বাংলা নয় গোটা উপমহাদেশে বাড়ি থেকে পালিয়ে প্রথম শিশু চলচ্চিত্র। তবে তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ঋত্বিক ঘটকের নির্মাণে বাড়ি থেকে পালিয়ে শিশুমনের গভীর মানসিক তথা দার্শনিক বয়ান হয়ে থেকে যায়।
শিবরাম চক্রবর্তীর গল্প অবলম্বনে ঋত্বিক ঘটকের এই ছবি একটি অনবদ্য আধুনিক সমন্বয়। সবার আগে যে বিষয় নিয়ে কথা বলা দরকার তা হল, ছবির শুরু ও ছবির শেষের ক্রেডিট। নামকরণ থেকে শুরু করে কলাকুশলিদের নাম, এই সমস্তটাই দেখে যেন মনে হয়, একজন শিশুর হাতের লেখা, এমনকি পরিচালকের নামও সেই ভঙ্গিতেই লেখা হয়েছে। তার পাশাপাশি আমরা দেখতে পাই শিশুসুলভ ভাবে ছবি আঁকার ঢঙে গোটা ছবির ন্যারেটিভের এক প্রকার ধারণা দেবার চেষ্টা। আমরা পরবর্তী কালে দেখতে পাব সত্যজিৎ রায় তাঁর ফিল্ম ক্যারিয়ারে যেকটি শিশুদের জন্য চলচ্চিত্র বানিয়েছেন, তাতে বাবার তিনি এই ট্রিটমেন্টকেই ব্যবহার করেছেন। গুপী গাইন বাঘা বাইনের ওপেনিং ক্রেডিটে গোটা ন্যারেটিভকে দেখানো হয়, সেখানে ছবির নাম ও কলাকুশলিদের নামও সেই একই রকম শিশুসুলভ ভঙ্গিতে লেখা হয়, সোনার কেল্লার ক্ষেত্রেও সেই একই জিনিস বজায় রাখেন সত্যজিৎ। এই ধরনের ট্রিটমেন্ট সবার আগে বলে দেয় যে ছবির দৃষ্টিভঙ্গি একজন শিশুর। ঋত্বিক ঘটক সেই থিমকে ক্রমাগত শব্দ, আবহ সংগীতেও বিভিন্ন ড্রিম সিক্যুয়েন্সের মাধ্যমে তুলে ধরেন। পরবর্তী সময় আমরা তারে জামিন পর (২০০৭)-এর ক্রেডিট সিক্যুয়েন্সেক সেই রকম ট্রিটমেন্ট দেখতে পাই।
ঋত্বিক ঘটকের বাড়ি থেকে পালিয়ে-র আগে পথের পাঁচালির মতো ছবি তৈরি হয়ে গেছে, কাজেই বাড়ি থেকে পালিয়ে কীভাবে বাংলার প্রথম শিশু চলচ্চিত্র হতে পারে! এখানে বলতে হয়, পথের পাঁচালির ন্যারেটিভের কেন্দ্রবিন্দুতে কিন্তু দুজন শিশু নয়, বরং গোটা পরিবারটাই গুরুত্বপূর্ণ এবং তারই অম্লমধুর সু-দুঃখের অংশীদার হতে থাকে অপু আর দুর্গা।
এ এক রাখালের গল্প
রবীন্দ্রনাথের প্রভাব ঋত্বিক ঘটকের শিল্পকর্মের আনাচাকানাচে লুকিয়ে আছে। রবীন্দ্রনাথের কাজ নিয়ে ঋত্বিক ঘটকের তুলনায় অনেক বেশি কাজ করেছেন সত্যজিৎ রায়। সেক্ষেত্রে ঋত্বিকের ফিল্মোগ্রাফিতে রবীন্দ্রনাথের গান থাকলেও, গল্প সেখানে নেই। এখান থেকে বোঝা যায়, যে ঋত্বিকের কাছে সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথের থেকেও দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সেই কারণেই বোধ করি, ঋত্বিকের কাজে অনেক খুঁজেও হলিউডের কোন প্রভাব পাননি সত্যজিৎ। (এখানে রবীন্দ্রনাথের ডিকলনাইজেশনের প্রতি ঋত্বিকের আগ্রহ প্রকাশ পায়, উপমহাদেশীয় আধুনিকতার মানে খুঁজতে গিয়ে এই ছিল রবীন্দ্রনাথের অঙ্গীকার।)
বর্ণপরিচয়ের শুরুতে বর্ণমালা দিয়ে বাক্য গঠন করে বিদ্যাসাগর মশাই যে উদাহরণ দিয়েছেন, সেখানে আমরা দুই ধরনের বালকের উল্লেখ পাই। এক হল গোপাল, যে যন সুবোধ বালক; সে সমস্ত কথা মেনে পড়াশোনা করে, ধর্মাচরণ করে। অন্যদিকে রয়েছে রাখাল। যার পড়ায় মতি নেই, আগামী জীবন তার সুখের হবে না। রবীন্দ্রনাথের মতে এটা এক রকমভাবে আধুনিক বাঙালির গোড়া পত্তনের কথাই বলছে। রবীন্দ্রনাথের মতে রাখাল, যে কিনা দামাল এবং অবাধ্য হলেও সে অসাধ্যকে ছুঁতে চাইছে, যা তাকে তার পারিপার্শ্বিকের বিষয়ে অনেক বেশি অবগত করছে। যেখানে গোপাল সুবোধ বালক, বাঙালি কৌলিন্যের সমস্ত নিয়ম মেনে সে হয়ে উঠবে একজন ভদ্র বাঙালি। ঋত্বিক ও শিবরামের গল্প ঠিক সেই রকম এক রাখালের বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাবার ও বাড়ি ফিরে আসার গল্প বলে। ঋত্বিক নিজেই বর্ণপরিচয়ের সেই রাখাল, কাজেই তাঁর গল্পের নায়ক শান্ত সুবোধ বালক যে হবে না। গল্প ও সিনেমা দুই ক্ষেত্রেই স্রষ্টারা ব্রাহ্মণ্যত্বের ভার থেকে বেরিয়ে জগৎকে দেখার ধারণাও দেয়। শুধু তাই নয়, গ্রামে কাঞ্চনের যে প্রধান শত্রু তার ব্যাপারে ক্রমাগত নালিশ করে বেড়ায় সে হল তার সমবয়সী; আরেকজন ব্রাহ্মণ সন্তান বিনোদ। বিনোদ হচ্ছে এই গল্পের গোপাল, যে খুব মন দিয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে তিলে তিলে নিজেকে এক ধর্মনিষ্ঠ ব্রাহ্মণে পরিনত করছে। কিন্তু আসলে যে গোটা ব্যাপারটাই ফাঁপা, সেটা বোঝাবার জন্য ঋত্বিক দেখান যে বিনোদ যখন কাঞ্চনকে ব্রহ্মশাপ দেবার চেষ্টা করে তখন তার পৈতে ছিঁড়ে যায়। বিনোদ আদপেই কুপমুণ্ডক। গ্রামের বাইরে সে কখনই বেরোবে না, নিজে থেকে জীবনকে খুঁজে নিতে চাইবে না, তার জন্য তার অবিভাবক যা ভেবে রেখেছে তাই হবে তার ভবিতব্য। কিন্তু কাঞ্চন সেই রকম ছেলে নয়। সে চায় বেরিয়ে পড়তে, পৃথিবীর আনাচ-কানাচ ঘুরে দেখতে ও জানতে। তাই পাঠ্য পুস্তকের নিচে লুকিয়ে সে পড়ে এলডোরাডোর ব্যাপারে, দক্ষিণ আমেরিকার দুর্ধর্ষ আদিম মানুষদের ব্যাপারে।
এখানে ঋত্বিকের আধুনিকতাই হল নিজের আশপাশের বাইরে বেরিয়ে বাকি পৃথিবীকে জানা এবং এইটা কোথাও গিয়ে পাশ্চাত্যের সাগর পেরিয়ে অন্য দেশের খোঁজ করা। সেই কারণেই সিনেমার শুরুতে ঋত্বিক সুর বাঁধেন যে কলকাতা শহর হলো, কাঞ্চনের এলডোরাডো। কিন্তু দর্শকের মনকে প্রশমিত করা ঋত্বিকের কাজ নয়। তাঁর শিল্পের আধুনিকতা অনেকটা পিকাসোর মতো। তাই সেই সোনার শহরে কাঞ্চনের কী পরিণতি হয় সেটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়। আমরা কাঞ্চনের মুখে সংলাপ শুনি, “এখানে এত দুঃখ কেন?” কাঞ্চনের এই পালিয়ে যাওয়া আসলে কি পালানোর গল্পে বলে, নাকি সেটা আবার ঘরে প্রত্যাবর্তনের গল্প সেটা - ছবির চলনে ধীরে ধীরে গুলিয়ে যেতে থাকে।
যেটা সব থেকে জরুরি তা হল, এই ছবিতে নায়কের প্রধান ক্রাইসিস- শহরে উপযোগী একটা কাজ জোটানো। যাতে সে অর্থ উপার্জন করে তার মা-কে কিঞ্চিত সুখী করতে পারে। যেটা তার বাবার কাছে বিলাসিতা ছাড়া কিছুই নয়। ঋত্বিকের বাড়ি থেকে পালিয়ে আদোপেই একটা আধুনিক রূপকথার গল্প। সেই রূপকথা কোনও স্বপ্নীল রাজ্যে নয়, ঘটে কলকাতা নামক জ্বলজ্যান্ত একটা আধুনিক শহরে। সেই শহরের বুক দিয়ে ট্রাম চলে, চলে হাওয়া গাড়ি, সেই শহরে আছে একটা মস্ত বড়ো ব্রিজ, যার নাম হাওড়ার পুল। গ্রাম থেকে পালিয়ে আসা কাঞ্চনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কলকাতাকে দেখা যায়। তাতে যেমন আছে কল্পনা, তেমনি আছে বাস্তবের রুঢ়তা। সিনেমা এমনিতেই শিল্পকলার ক্ষেত্রে একটি আধুনিক মাধ্যম এবং শিল্প-বিপ্লবের ফসল, আদ্যপ্রান্ত রাবীন্দ্রিক ঋত্বিকের কাছে তাই বোধহয় অন্যরকম ছবি তোলার ও ফ্রেমে ন্যারেটিভ আবধ্য করার একটা প্রচেষ্টা সর্বদাই লক্ষ করা গেছে। এইভাবেই বুঝি ঋত্বিক নিজের শিল্পকে ‘ডিকলনাইজ’ করে গেছেন। শুরুর দিকেই আমরা গান শুনতে পাই, “অনেক ঘুরে শেষে আইলাম রে কলকাতা…”।
এই গানের আগে অবধি ছবিটা কাঞ্চনের ছিলো। এই গান এবং গানের সিক্যুয়েন্সেই, ঋত্বিক ঘটকের এই ছবি কিঞ্চিৎ আত্মজীবনীমূলকও মনে হতে পারে। এই বাউল অর্থোপার্জনের জন্য শিয়ালদহ স্টেশনের পুলের ওপর দাঁড়িয়ে স্বাধীন ভারতবর্ষের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহরে এই গান ধরে। গানের প্রথম ছত্রেই আমরা শুনি, গায়ক বলে “পদ্মাপারের চরেই আমার ছিল রে ঘর বাড়ি…”। যারা খোঁজ খবর রাখেন, তারা জানেন পদ্মা নদী নিয়ে ঋত্বিক ঘটক সব সময় স্পর্শকাতর। কাজেই কাঞ্চনের চলে আসার গল্প নাকি কাঞ্চনরূপী ঋত্বিকের, সেটা সত্যি বলা মুশকিল। এইখানে আরেকটা দৃশ্যের নির্মাণের কথা মনে পড়ছে। সেই বিয়েবাড়ি সিক্যুয়েন্সে বিয়েবাড়ি শেষে কাঞ্চন যখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছে, সেখানে উচ্ছিষ্ঠ খাবার নিয়ে নিরন্ন মানুষের সঙ্গে লড়াই চলছে পথকুকুরের। এই দৃশ্যের নির্মাণে ঋত্বিক দর্শককে নির্দ্বিধায় নিয়ে যান ৪২-এর মন্বন্তরে। উপন্যাসে শিবরাম যে গৃহহীন মানুষদের উল্লেখ করেছেন তারা হিন্দিভাষী, কিন্তু ঋত্বিকের এই অভুক্ত মানুষগুলো বাঙালি এবং তারা বলে দেশে দুর্ভিক্ষ, তাই এখানে খাবারের সন্ধান করছি। দৃশ্য নির্মাণের ক্ষেত্রে ঋত্বিক যে মন্বন্তরের হাড় জিরজিরে মানুষদের ছবি নির্মাণ করতেই চাইছেন তাতে আর কোনও সন্দেহ থাকে না।
বাড়ি থেকে পালিয়ে-র ন্যারেটিভ নির্মাণে ঋত্বিক যে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের ব্যবহার করছেন তাও খুব অসামান্য একটা পড়বার ও উপলব্ধি করার জায়গা। বাড়ি থেকে পালিয়ে শহরে এল কাঞ্চন। পালিয়ে আসার প্রধান কারণ তার বাবা। যে তাকে মারে, যে তাকে বকে, যে তাকে বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়, চানক্যের কঠিন বাক্য। কঠিন বাক্য ঘোরতর ব্রাহ্মণ করে তোলার। নীতিবাণ ব্রাহ্মণ। শহরে এসেই তার প্রথম পু্রুষ বন্ধু হল হরিদাস। যে শহরের বিভিন্ন পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে বাচ্চা ছেলেমেয়েদের বুলবুল ভাজা বেচে এই বিশাল শহরে কোন মতে দিন গুজরান করে। সেভাবে দেখতে গেলে হরিদাসও এই শহরের এক হতাশ হত দরিদ্র মানুষ, যে কিনা বাঁচতে এখনও ভোলেনি। এই মানুষটিও শিক্ষক এবং সেও অনেক ছেলেবেলায় বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে। শুধু তাই নয়, কাঞ্চনের বাবার মতো সেও একজন ইস্কুল মাস্টার। শহরের সব কটা পুরুষই তার না হতে পারা বাবার মতো। কাঞ্চন ঠিক যেমন ফুর্তিবাজ, হাসিখুশি বাবা চেয়েছিল ঠিক সেই রকম। সেই কারণেই হয়তো বাড়ি থেকে পালিয়ে রূপকথা সুলভ মনে হয়।
ঋত্বিক মানবদরদী শিল্পী। তাই সেই শহরের চমক ধমকের ঊর্দ্ধে গিয়ে তাঁর চোখে ধরা পড়ে, উঁচু অট্টালিকা বা ব্রিজের নিচে থাকা মানুষগুলো। যা এই ছবির চলনে বারবার আসবে।
শহরে এসে কাঞ্চন যে শুধু তার বাবার মতো কিছু প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষের সান্নিধ্য পায় তা নয়, সে তারও বিভিন্ন রকমের ভার্সন দেখতে পায়। মাদারির খেলার আসরের শিশুশ্রমিক থেকে শুরু করে ধর্মতলার রাস্তায় ছবি এঁকে অর্থোপার্জন করা শিশু ভিখারি। তারা প্রত্যেকেই একই কথা বলে যে তারা বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে। এবং কাঞ্চনের কাছে এক গভীর আধুনিক প্রশ্ন তুলে ধরে যে শহরে এসে জীবনযাপন ও অর্থোপার্জন কোনওটাই সহজ কথা নয়। এই ছবি বারবার তার চলনের মাধ্যমে কাঞ্চনের কী পরিণতি হতে পারতো, সেই ভবিষ্যৎকে ডকুমেন্ট করার চেষ্টা করে।
প্রেমিক ঋত্বিক
প্রেম উদযাপনের ক্ষেত্রে ঋত্বিক ঘটক কখনই কার্পণ্য করেননি। বাড়ি থেকে পালিয়ে-তেও তাই দেখতে পাই আমরা। শহরের এক অচেনা বিয়েবাড়িতে কাঞ্চন খুঁজে পায় তার সীতাকে। সে হচ্ছে শহরের বুকে অনেক আদরে বড়ো হতে থাকা মিনি। কাঞ্চন প্রথম দর্শনেই তার প্রেমে পড়েছে, স্বপ্নে দেখে সে তার প্রেমিকাকে নিয়ে তার মায়ের কাছে গেছে। অর্থাৎ ঋত্বিক কখনই শিশুদের করুণার আতস কাচে দেখতে রাজি নন। তাঁর কাছে, শিশুরাও যথেষ্ঠ প্রাপ্তবয়স্ক এবং তাদের দেখা ও উপলব্ধিরও এই আপাদমস্তক হৃদয়হীন সমাজে মূল্য আছে।
বিয়েবাড়ি সব সময়েই নতুন প্রেমের পরিসর তৈরি করে, তেমনি এক শহরের বিয়েবাড়িতে ঢুকে পড়ে কাঞ্চন। সেখানেই তার প্রথম চোখে পড়ে ও মনে ধরে মিনিকে। মিনির মতো মিষ্টি মেয়েকে দেখে, কাঞ্চন একটি অচেনা ছেলের কাছে জানতে চায় তার নাম, তাতেই বাধে গণ্ডগোল। স্বভাবতই মিনির বন্ধুরা এই স্পর্ধার জন্য খানিক নাকাল করে কাঞ্চনকে। এই দৃশ্য লেখা যত না সহজ, তাকে ফিল্মবন্দি করা তার থেকে ঢের কঠিন। কারণ এখানে এই সমস্ত শিশুদের আচরণ প্রাপ্তবয়স্কদের মতন। সত্যজিতের ক্ষেত্রে এই আলোচনা খুবই হয়েছে যে, তিনি কীভাবে শিশু শিল্পীদের দিয়ে অভিনয় করাতেন। কিন্তু একটু মন দিয়ে দেখলে দেখা যাবে, যে সত্যজিতের শিশু শিল্পীদের সংলাপ ও দৃশ্য খুবই মাপা এবং সীমিত। কিন্তু বাড়ি থেকে পালিয়ে ছবির এই দৃশ্যে শিশু শিল্পীদের সংলাপ মোটেই সীমিত নয়। সেখানে যেমন প্রয়োজন অভিনয় শৈলীর, তেমনি প্রয়োজন দক্ষ সংলাপ উচ্চারণের। তার থেকেও বড়ো কথা প্রেমের ভাব প্রকাশ করা বা তার আবহ তৈরি করা। এখানে সত্যি বিস্ময় জাগে, যে ঋত্বিক তাঁর শিশু শিল্পীদের ঠিক কী নির্দেশ দিয়েছিলেন এই দৃশ্যকে ফিল্মবন্দি করার সময়। তবে যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হল ঋত্বিকের প্রেমের প্রকাশ। নরনারীর মধ্যে নিবিড় নির্মল প্রেমের বিকাশ সবসময়েই ঋত্বিকের ছবির বিষয় এবং কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেছে, বাড়ি থেকে পালিয়েও তার ব্যতিক্রম নয়।
হরিদাস ও ছেলেধরা
কলকাতা বড়ো শহর সেখানে, ছেলেধরা ঘুরে বেড়ায়। এই তথ্য দিয়েই কাঞ্চনকে গ্রামে আবদ্ধ করে রাখতো তার অবিভাবকেরা। কিন্তু কলকাতা শহরে এসে প্রথম যে মানুষটা তার বন্ধু হয়ে ওঠে, তাকে দেখে ছেলেধরা গোছের মনে হলেও আসলে সে ছেলে ধরা নয়; বরং একজন স্কুল শিক্ষক, যে দেশভাগের পরে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পালিয়ে কলকাতা শহরে এসেছে। সে নকল সাদা দাড়ি ও পরচুলো পরে, হরিদাসের বেশ ধরে, কলকাতা শহরের শিশুদেরকে বুলবুলি ভাজা বিলি করে বেড়ায়। এইভাবেই তার দিন কাটে শহরে। সব থেকে মজার ব্যাপার হলো, এই হরিদাসের সেভাবে কোনও পূর্ণাঙ্গ বর্ণনা আমরা শিবরামের লেখাতে পাই না, কিন্তু ঋত্বিক যখন ছবি বানালেন তখন তার হরিদাসের মেকআপ করালেন অনেকটা রবীন্দ্রনাথ বা সুকুমার রায়ের হ-য-ব-র-ল-এর গেছো দাদার মতো।
হরিদাসের কালো জোব্বাখানা দেখলে মনে হয়, একটা দাঁড় কাকের শরীর। আদি অনন্তকাল ধরে সে রয়েছে বাংলায়, এবং তার মাথাখানা এক প্রাজ্ঞ বুড়োর। তার কাজই যেন গ্রামগঞ্জ থেকে পালিয়ে আসা ছেলেদেরকে শহরের বুকের সমস্ত বিপদ থেকে সমস্ত দুঃখযন্ত্রণা থেকে বাঁচিয়ে রাখা। এইখানেই বাড়ি থেকে পালিয়ের আখ্যান অনেক বেশি রূপকথা সুলভ হয়ে ওঠে। কিন্তু এই রূপকথা অনেকটাই Alice in the Wonderland-এর মতো। শুধুই সুখের গল্প নয়, এখানে দুঃখের ও ভয়ের আখ্যানও আছে। শহরের বুকে একা ঘুরতে ঘুরতে কাঞ্চনের আলাপ হয়, তারই বয়সি আরেকটি ছেলের সঙ্গে, যাকে আপাত দৃষ্টিতে কাঞ্চন ভাবে মুক ও বধির। কী মজার জীবন, রাস্তায় ছবি এঁকে রোজগার করা। কাঞ্চন পিছু নেয় এই ছেলেটির। সে জানতে পারে, যে ছেলেটি প্রথমত মুক-বধির নয় এবং তার উপার্জিত অর্থের ওপর তার কোন অধিকার নেই। অধিকার আছে কিছু মানুষের, যারা শহরের আনাচে কানাচে, ছায়াগুলির মধ্যে ঘুরে বেড়ায়, যারা নির্মম। তারাই আসল ছেলেধরা। তারা কোনও লজেন্স বা বুলবুল ভাজার লোভ দেখিয়ে শিশুদের বস্তায় ভরে না। তারা কালোগাড়িতে আনাগোনা করে এবং চিল শকুনের মতোই শহরের বুক থেকে ছোটো ছোটো শিশুদের ধরে নিয়ে গিয়ে গোলাম বানিয়ে রাখে। এদের হাত থেকে কাঞ্চনকে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে খুঁজে বেড়ায় হরিদাস।
কলকাতা : ঋত্বিকের ‘এলডোরাডো’
কলকাতা চিরকালই একটা পেল্লায় জাঁদরেল শহর ছিল। বড়ো উঁচু অট্টালিকা হুশহাশ করে ছুটে আসা গাড়ি, বাস, ট্রাম দিয়ে গড়ে ওঠা একটা আধুনিক জান্তব শহর। পূর্ব পাকিস্তান থেকে উঠে আসা ঋত্বিকের কাছে, তার একটা মাদকতা আছে, এই শহরে তার পড়াশোনা, বেড়ে ওঠা, রাজনীতিতে ঝাঁপিয়ে পড়া, তারই ডাকে বাংলার সাংস্কৃতিক কৃষ্টিকে রাজনীতির হাতিয়ার করে সমাজসংস্কারে ব্রতী হওয়া। তাই এই শহর যেন তার এলডোরাডো। মুখে না বললেও ঋত্বিকের এই কাজে সেটা সম্পূর্ণ বোঝা যায়। ঋত্বিক মানবদরদী শিল্পী। তাই সেই শহরের চমক ধমকের ঊর্দ্ধে গিয়ে তাঁর চোখে ধরা পড়ে, উঁচু অট্টালিকা বা ব্রিজের নিচে থাকা মানুষগুলো। যা এই ছবির চলনে বারবার আসবে। বাড়ি থেকে পালিয়ে-তে কলকাতার নির্মাণ অন্যান্য তৎকালীন ছবির থেকে খুবই অন্যরকম। এই ছবিতে হাওড়া ব্রিজ একটা চরিত্র। ভোরের আলোতে কুয়াশাচ্ছন্ন ব্রিজকে যেভাবে ঋত্বিক লেন্সবন্দি করেছেন, তা এক অনবদ্য ছবি।
কাঞ্চন রাতে ট্রেনে চেপে, ভোরবেলা এসে নামে হাওড়া স্টেশনে। স্টেশন চত্বর থেকে বেরিয়ে এসেই তার সঙ্গে দেখা হয়, গঙ্গা নদী এবং হাওড়া ব্রিজের। গঙ্গার বুক জুড়ে স্টিমারের আনাগোনা মন দিয়ে দেখে কাঞ্চন। দেখতে দেখতে কানে ভেসে আসে, একটি পাখির ডাক যা শহরের কোলাহলে শুনতে পাওয়া বিরল, মজার ব্যাপার এই পাখিগুলি গাছের শাখায় বসে না, বসে হাওড়া ব্রিজের কড়িবর্গায়। এখানেই থামতে পারতেন পরিচালক। এই সিক্যুয়েন্সের কিছু দৃশ্য পরে, আমরা দেখতে পাব গরিব বাউল, শিয়ালদহ ব্রিজের ওপরে গান ধরছে, “আমি অনেক ঘুরিয়া শেষে আইলাম রে কলকাতা…”। এই গানের শেষ ছত্রে, সেই বাউল তার হাওড়া ব্রিজকে নিয়ে বিস্ময়ের কথা প্রকাশ করছে। এই দৃশ্যে হাওড়া ব্রিজকে আবার ফিরিয়ে আনেন ঋত্বিক ঘটক।
সলিলের সিম্ফনি
এই লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, যদি সলিল চৌধুরীর সংগীতের প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা না করা হয়। ঋত্বিক ঘটকের ছবিতে মূলত আমরা ভারতীয় যন্ত্রসংগীতের ব্যবহারই বেশি লক্ষ করেছি, কিন্তু বাড়ি থেকে পালিয়ে সেখানে একেবারেই অন্যরকম প্রয়োগ। তাছাড়াও ঋত্বিকের ছবির সংগীত পরিচালনা মূলত করেছেন জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, কিন্তু বাড়ি থেকে পালিয়ের ক্ষেত্রে সেই ভার গিয়ে পড়ে সলিল চৌধুরীর ওপর। সলিল এবং ঋত্বিক দুজনেই হয়তো মনে করলেন, যে এই আধুনিক যুগে দাঁড়িয়ে শিশু-চলচ্চিত্র বানাবার ক্ষেত্রে যে আয়োজন দরকার, তা হয়তো ভারতীয় যন্ত্রানুসঙ্গ দিয়ে করা মুশকিল। তাই কাঞ্চন গ্রামের ছেলে হলেও তার এই গল্পের অধিকাংশই ঘটবে কলকাতা শহরে। সলিল চৌধুরী তাই সৃষ্টি করেন একটি অদ্ভুত সিম্ফনি। সেই সিম্ফনিতে মূলত আমরা দেখি, বেহালা, ইংলিশ ফ্লুট, ড্রাম, ট্রাম্পেট ও স্যাক্সোফোন জাতীয় যন্ত্রের জগঝম্প। আবার তার পাশাপাশি, যখন বাউলের গলায় গান হচ্ছে, সেখানে তারা ব্যবহার করছেন খমক এবং তবলার। সেই কারণেই বাড়ি থেকে পালিয়ে-র মিউজিক ট্র্যাক একটি বিরল বিষয় হয়ে থেকে যায় বাংলা চলচ্চিত্রের সংগীত প্রয়োগের ইতিহাসে।