যেভাবে বর্গিদের প্রতিহত করলেন আলিবর্দি খান

বাংলায় তখন আলিবর্দি খানের রাজত্ব। মানে বাংলায় নবাবি শাসনের সবথেকে গৌরবময় সময় চলছে। এরই মধ্যে সুদূর মহারাষ্ট্র থেকে ধেয়ে এল দুর্ধর্ষ লুঠেরার দল। একবার নয়, টানা দশ বছর ধরে তারা বাংলার পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে ঢুকে লুঠপাট চালাত। অথচ তাদের ডাকা হয়েছিল খাল কেটে কুমির আনার মতোই। বাংলার নবাব সরফরাজ খানকে এক যুদ্ধে হত্যা করে নবাব হয়েছিলেন আলিবর্দি খান। সরফরাজ খানের শ্যালক রুস্তম জং ছিলেন ওড়িশার নায়েব-নাজিম অর্থাৎ আঞ্চলিক শাসনকর্তা। তিনি ঘোষণা করলেন যে আলিবর্দিকে নবাব হিসেবে মানবেন না। আলিবর্দির সঙ্গে তাঁর যুদ্ধ লাগল। ১৭৪১ সালের মার্চে রুস্তমকে যুদ্ধে হারিয়ে আলিবর্দি ওড়িশার ভার দিলেন নিজের ভাইপোকে। রুস্তমও এত সহজে হার মানার পাত্র নন। মারাঠা সেনাপতি রঘুজি ভোঁসলের সঙ্গে তিনি ষড়যন্ত্র করলেন। মারাঠাদের সাহায্যে তিনি ওড়িশা ছিনিয়ে নেবেন, এরকমই কথা হয়েছিল। অবশ্য রঘুজির ইচ্ছে ছিল, এই সুযোগে আলিবর্গির থেকে দখল করে নেবেন কটক, পাটনা আর মুর্শিদাবাদ।
মারাঠাদের সাহায্যে রুস্তম জং ওড়িশা দখল করে নিলেন ১৭৪১ সালের আগস্টে। জয়ের আনন্দে মারাঠা সৈন্যরা ওড়িশা ছাড়িয়ে বাংলায় ঢুকে লুঠপাট শুরু করল। ওদিকে আলিবর্দিও জেদি মানুষ, কিছুতেই হাল ছাড়বেন না। সে বছরের ডিসেম্বরে মারাঠাদের হারিয়ে আবার ওড়িশাকে নিজের রাজত্বে ফিরিয়ে আনলেন। কিন্তু তিনি মুর্শিদাবাদের ফিরে আসার আগেই ভাস্কর পণ্ডিতকে অশ্বারোহী বাহিনীর প্রধান করে বাংলায় পাঠালেন রঘুজি। তিনি পাঞ্চেত হয়ে বাংলায় ঢুকে লুঠপাট চালাতে শুরু করেন। মারাঠা সেনাবাহিনীর সবথেকে নিচু পদের যোদ্ধাদের বলা হত ‘বারগির’। এদের নিজস্ব কোনো ঘোড়া কিংবা অস্ত্র থাকত না। এইসবের জোগান দিতেন রাজা। অন্যদিকে বাকি সৈন্যদের নিজস্ব ঘোড়া আর অস্ত্র থাকত। তাদেরকে বলা হত শিলাদার। ‘বারগির’-রা একধরনের ছুঁচলো বর্শা নিয়ে যুদ্ধ করত, যেগুলোকে মারাঠি ভাষায় ‘বরচি’ বলা হত। সেই ‘বরচি’ থেকেই ‘বারগির’ কথাটা এসেছে। আবার বাংলায় ‘বর্গি’ শব্দটা চলে এসেছে এই ‘বারগির’ কথাটা থেকে। বাঙালিদের কাছে ‘বর্গি’ হয়ে উঠেছে সমস্ত মারাঠা আক্রমণকারী বাহিনীর সমার্থক।
বর্ধমানে আর কাটোয়ায় নবাবের বাহিনীর সঙ্গে বর্গিদের যুদ্ধ হয়। সে যুদ্ধে হেরে মারাঠারা তো বাংলা ছেড়ে পালাল, কিন্তু তারা আবার ওড়িশা দখল করে নিল। তবে নবাব ১৭৮২ সালের ডিসেম্বর নাগাদ সেখান থেকেও তাদের গলা ধাক্কা দিয়ে বার করে দেন। তারপর আবার ১৭৪৩ সালে রঘুজি বাংলা আক্রমণ করলেন। এদিকে নবাব তখন মারাঠাদের পেশোয়া, অর্থাৎ প্রশাসনিকভাবে যাঁর স্থান রঘুজি ভোঁসলের অনেক ওপরে, সেই বালাজি বাজিরাও-এর সঙ্গে একটা চুক্তি করলেন। সেই চুক্তিতে ঠিক হল, নবাব মারাঠা সম্রাটকে চৌথ বা কর দেবেন, তার বদলে মারাঠারা বাংলা ছেড়ে চলে যাবে। পেশোয়াকে তিনি সেনাবাহিনীর খরচ চালাতে ২২ লক্ষ টাকা দেবেন বলেও ঠিক হয়। এরপর নবাব এবং পেশোয়ার যৌথ সৈন্যদল রঘুজিকে আক্রমণ করে। রঘুজির বাহিনী বাংলা ছেড়ে পালায়।
তারপর আবার বর্গিবাহিনী ১৭৪৪ সালে বাংলা আক্রমণ করল। নেতৃত্বে ছিলেন ভাস্কর পণ্ডিত। পেশোয়ার সঙ্গে রঘুজির সমঝোতা হয়ে গেছিল, ফলে পেশোয়া আর নবাবের পক্ষ নিলেন না। নবাব প্রথমে হতবাক হলেও সামলে নিয়ে নিজের রাজত্বকে বাঁচানোর দিকে মন দিলেন। এবার সরাসরি যুদ্ধের পথে গেলেন না তিনি। বরং ছলনার আশ্রয় নিলেন। সন্ধি করবেন বলে আমন্ত্রণ জানালেন ভাস্কর এবং তাঁর দলবলকে। মানকাড়া নামের একটা জায়গায় ভাস্কর তাঁর অনুচরদের নিয়ে নবাবের তাঁবুতে দেখা করতে এলে সেখানেই নবাবের লোকজন তাঁদের হত্যা করল।
এত কিছুর পরেও কিন্তু বর্গি আক্রমণ থামল না। ১৭৮৫ সালে নবাবের আফগান সৈন্যরা বিদ্রোহ করে বসে। সেই সুযোগে বাংলায় ঢুকে বর্গিরা ওড়িশা, মেদিনীপুর, বর্ধমান, বীরভূম দখল করে নিতে থাকে। সঙ্গে চলতে থাকে ভয়ানক লুণ্ঠন। তবে গঙ্গা-হুগলি নদী বহুক্ষেত্রেই বর্গি আক্রমণ প্রতিহত করতে যথেষ্ঠ সহায়ক হয়েছিল। কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া বর্গিরা হুগলি নদী পার করতে পারেনি। আলিবর্দি খান শেষ পর্যন্ত বাংলা থেকে মারাঠাদের তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং নবাবের সেনাপতি মিরজাফরের কর্তৃত্ব এতে সবথেকে বেশি। মিরজাফরের নেতৃত্বে নবাবের সেনাবাহিনী বীরের মতো বর্গিদের দখল করে একের পর এক অঞ্চল ছিনিয়ে নিয়েছিল। তবে মারাঠা বর্গিরা ওড়িশা দখল করে নিয়েছিল আবার। সেখান থেকে আলিবর্দি তাদের হটাতে পারেননি। মারাঠাদের বন্ধু মির হাবিব ওড়িশার শাসনকর্তা নিযুক্ত হলেন। ১৭৫১ সালে নবাবের সঙ্গে রঘুজির চুক্তি হয়, যার শর্ত ছিল, নবাব মারাঠাদের প্রতি বছর চৌথ দেবেন, তার বদলে মারাঠারা আর বাংলা-বিহার আক্রমণ করবে না। পরে ১৭৫২ সালে মারাঠা সৈন্যরাই মির হাবিবকে হত্যা করে। ওড়িশা মারাঠা সাম্রাজ্যের একটা প্রদেশে পরিণত হয়।
তথ্যসূত্র - বাংলাদেশের ইতিহাস, আলিবর্দী ও মারাঠা আক্রমণ, ড. মুহম্মদ আব্দুর রহিম।