বঙ্কিমচন্দ্রের হাত ধরে ক্ষমা চেয়েছিলেন এক ব্রিটিশ

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং যদুনাথ বসু ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম স্নাতক। ১৮৫৮ সালে গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন বঙ্কিমচন্দ্র। যশোরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এবং ডেপুটি কালেক্টর হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন ২০ বছর বয়সে। চাকরির সূত্রে নানা জেলায় ঘুরতে হয়েছে। অত্যন্ত স্বাধীনচেতা ছিলেন, তাই ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে খিটিমিটি লেগেই থাকত।
১৮৬৯ সালে বদলি হয়ে বহরমপুর যান তিনি, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টরের পদে। এখান থেকেই ১৮৭২ সালে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকা সম্পাদনা এবং প্রকাশনা শুরু করেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যা এক যুগান্তকারী ঘটনা। বহরমপুরে থাকাকালীনই ‘বঙ্গদর্শন’-এর জন্য ‘বিষবৃক্ষ’, ‘ইন্দিরা’, ‘যুগলাঙ্গুরীয়’, ‘চন্দ্রশেখর’ ইত্যাদি রচনা করেন বঙ্কিম।
১৮৭০ সালের ১৫ ডিসেম্বরের ঘটনা। বঙ্কিমচন্দ্র পালকি করে বহরমপুর স্কোয়ার ফিল্ডের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। ওই মাঠে তখন ক্রিকেট খেলছিলেন ব্রিটিশরা। বঙ্কিমের পালকি আটকালেন কর্নেল ডাফিন নামের এক ইংরেজ। তিনি পালকির দরজায় করাঘাত করতে বঙ্কিম পালকি থেকে নেমে বলেন, “Who the Devil you are?” ডাফিন কোনো উত্তর দিলেন না, বঙ্কিমকে হাত ধরে সরিয়ে দিলেন। এতে চূড়ান্ত অপমানিত হলেন বঙ্কিমচন্দ্র। তাঁকে প্রহার করেছিলেন ডাফিন, এমন মতও পাওয়া যায়। মাঠের অন্যান্য গোরা সাহেবরা কেউ বঙ্কিমচন্দ্রকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি।
তেজস্বী বঙ্কিম অবশ্য দমে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না। পরের দিনই ডাফিনের বিরুদ্ধে আদালতে মানহানির মামলা করে বসলেন। বহরমপুরে তাঁর বিপুল প্রভাব তখন। দেড়শো জন আইনজীবী তাঁর পক্ষে ওকালতনামায় সই করেছিলেন। অন্যদিকে কর্নেল সাহেব একজন উকিলও জোগাড় করতে পারলেন না। শেষ পর্যন্ত জেলা জজ বেনব্রিজের দ্বারস্থ হলেন। এই ব্রেনব্রিজও আগের দিন ছিলেন মাঠে, কিন্তু বঙ্কিমের পাশে দাঁড়াননি। যদিও দু’জনের আলাপ ছিল আগে থেকেই।
যাই হোক, মামলায় বেনব্রিজ মধ্যস্থতা করতে রাজি হলেন। কিন্তু শর্ত একটাই, কর্নেল ডাফিনকে ক্ষমা চাইতে হবে বঙ্কিমচন্দ্রের কাছে। ডাফিনের আর কোনো উপায়ও ছিল না। আদালত চত্বর তখন লোকে লোকারণ্য। সবার সামনেই বঙ্কিমের হাত ধরে ক্ষমা চাইলেন কর্নেল ডাফিন। বঙ্কিম তখন এই মামলা প্রত্যাহার করে নেন।
আরও পড়ুন: ইতিহাসের ধূসর জগতে ঢোকার পথ দেখান শরদিন্দু
এই মামলার সূত্রে লালগোলার রাজা যোগীন্দ্রনারায়ণ রায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয় বঙ্কিমের। তাঁর রাজবাড়িতেও ছিলেন অতিথি হিসেবে। লালগোলার সেই রাজবাড়ির উত্তরদিকে বয়ে চলেছে ‘কলকলি’ নামের ছোট্ট নদী। একটু দূরে পূর্ব দিকে পদ্মা আর ভৈরবী নদী। জায়গাটা ঘন অরণ্য। তিন নদীর সংগমস্থলে তান্ত্রিকদের বাস। এই জঙ্গলে দেবী জগদ্ধাত্রীর মন্দির, শৃংখলিত নগ্নিকা মহাকালীর মন্দির এবং দশভুজা দুর্গার মন্দির দেখে বঙ্কিম মুগ্ধ হন। এই অরণ্য এবং মন্দিরগুলি তাঁর মনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল, ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে যার প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। সেই গল্প আরেকদিন হবে।
তথ্যঋণ – অরবিন্দ সরকার, সুদীপ জোয়ারদার