বাংলার আসনশিল্পের অন্দর-কথা ৬

“অতিথি সেবা মানুষের ধর্ম, অতিথিকে বিমুখ করতে নেই”
–অক্ষয়তৃতীয়া ও পৃথিবী ব্রত
উপনিষদের একটি শ্লোকে ভারতবর্ষের চিরন্তন বাণীটি গাঁথা আছে-- ‘অতিথি দেব ভবঃ’। এই চিরন্তন বাণীকে ধারণ ও বহন করেছেন বাংলার নারী সমাজ। বাড়িতে অতিথির বসার জন্য আসন বুনেছেন। আসনের মধ্যে বোনা হয়ে গেছে বাংলার নারীর শিল্পগুণের পরিচয়ও। আসনের নকশা, সৌন্দর্যচেতনা মানুষকে মুগ্ধ করেছে। আসন একাধারে প্রমাণ করে যে, আবহমানকাল ধরে বাংলার জনজীবন ও লোকজীবনের ভিতর এক নান্দনিক মূল্যবোধের প্রবাহ ছিল। আসনের শিল্পধারা বয়ে চলেছে আদিমকাল থেকে। আসন বাঙালী রমণীদের কাছে ধর্মচিন্তা, মঙ্গলচিন্তা, সৌন্দর্যবোধের এক আবেগজারিত সমন্বয়।
আরও পড়ুন
বাংলার আসনের অন্দরের কথা ১
শীলা বসাক ‘বাংলার ব্রতপার্বণে’ বলেছেন– “পুরুষশাসিত সমাজে নারীদের স্থান সম্পর্কে কেউ মাথা ঘামায়নি বা মূল্যায়ন করেনি, সেই সময়েও নারী গৃহ-অভ্যন্তরে নিজের আসনটি ঠিক চমৎকার ভাবে গুছিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু, আমরা জানি প্রাচীনকাল থেকে আদিম সমাজে কৃষিকাজ, উর্বরতা বৃদ্ধি করতে নারী সমাজের অবদান কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।”
বঙ্গসমাজে নারীরাই সংসারের নানা খুঁটিনাটি বিষয়ে পারদর্শী। অবসর সময়ে নানা শিল্পদ্রব্য বা সামগ্ৰী তৈরি করেছেন। বুনেছেন নকশিকাঁথা থেকে আসন। আসনগুলি সৌন্দর্যস্থাপনের একটি বিশেষ সামগ্ৰী অতিথিদের কাছে। আজও বাংলার ঘরে ঘরে আসন দিয়ে বা বসিয়ে অতিথিদের আপ্যায়নের রীতি প্রচলিত।
মানুষের কর্মব্যস্ততা দিন দিন বাড়ছে। প্রত্যন্ত গ্ৰামগুলিতে আধুনিক প্রযুক্তি থাবা বসিয়েছে উন্নয়নের। প্রযুক্তি মানুষের অবসর কমিয়েছে। এছাড়া, গ্ৰামগুলিতে কর্মব্যস্ততা বেড়েছে, সরকারি বিভিন্ন যোজনা বা কাজে পুরুষ ও মহিলা নির্বিশেষে যোগদান করছে। ফলে, মহিলাদের অবসর সময় আরো কমে গেছে। যে সময়ে তারা কাঁথা বা আসন বুনত, সেই সময়গুলি কাজের ব্যস্ততায় কেটে যায় এখন।
আরও পড়ুন
বাংলার আসনশিল্পের অন্দর কথা ২
আধুনিকতার থাবা চারিদিকে এখন। আসন-পিঁড়ি পেতে বসার চল আর নেই। সোফাসেট, ডায়নিং টেবিলে বসে খাওয়া দাওয়া হয় এখন, ফলে আসনশিল্পীদের একটা সংকটময় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আগে জন্মদিন, অন্নপ্রাশন ও বিয়েতে শিল্পবস্তু হিসাবে আসন, কাঁথা ইত্যাদি দেওয়ার চল ছিল। বর্তমানে সেখানে প্লাস্টিকের খেলনা বা সামগ্ৰীর ছড়াছড়ি।
যে অবসর সময়ে তারা কল্পনা বুনে বুনে সবচাইতে মূল্যবান সামগ্ৰী তৈরি করত, এখন সেই অবসর সময়গুলিতেই টিভি-সিরিয়াল দেখে কাটায় গ্ৰামের মহিলারা। নিজের হাতে বানানো জিনিসপত্রের বদলে যে কোনো প্রয়োজনে বাজারের সুলভ ও বিচিত্র সব গৃহস্থ-উপকরণ কিনতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে, ধীরে ধীরে চাপা পড়ে যাচ্ছে মহিলাদের ঐকান্তিক নিজস্ব শিল্পসৃষ্টি। আসন এখন উচ্চবিত্তদের ঘরের দেওয়ালে শোভাবর্ধন করছে। এছাড়া বিছানার চাদরে, কুশান কভারে স্থান পেয়েছে। হাতে বোনা আসনের জায়গায় বাজার এখন ছেয়ে গেছে মেশিনে তৈরি আসনে।
আমরা যদি চাই, আসনশিল্প ক্ষুদ্রতর গণ্ডী ভেদ করে বৃহত্তর গন্ডির সাথে পা মেলাক, কুটির শিল্প বৃহত্তর জগতে স্থান পাক, জনপ্রিয়তা লাভ করুক-- তাহলে অনেক ব্যাক্তিবর্গকে, নানা শিল্প প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি সাহায্য পেলে তবেই আসনশিল্প অবলুপ্তির পথে অগ্ৰসর হবে না।
এখন অবশ্য বেশকিছু লোকায়ত সংগঠন বাংলার আসনশিল্পগুলি বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। তারা আসনগুলি বিক্রয়ের ব্যবস্থা করেছেন। আরো নতুন নতুনভাবে আসনশিল্পের নানা প্রকরণের সন্ধান জারি রেখেছেন তারা। অনেক শিল্পীদের এক ছাতার তলায় আনতে পেরেছেন।
আশার কথা এটাই, বাংলার উৎসব, অনুষ্ঠানে এখনো আসনের ব্যবহার হয়। আধুনিক প্রযুক্তি যতই বলীয়ান হয়ে উঠুক না কেন, অন্নপ্রাশন, বিবাহ, পৈতে, শ্রাদ্ধ কোনোটাই আসন ছাড়া চলে না। লোকশিল্পের নানা অনুষ্ঠানে এখনও মহিলাদের দেখা যায়। এখনও এই বাংলায় মেয়েদের সৃজনীশক্তি ও সৌন্দর্যবোধ কতখানি অটুট রয়েছে গ্ৰাম ঘুরে ঘুরে না দেখলে বিশ্বাসই হয় না। আর, সেই সৃজনীশক্তিকে বুকের নকশায় গেঁথেই আজো বেঁচে আছে বাংলার আসনগুলি।
আসনগুলির শিল্পীরা হলেন– সন্ধ্যা চৌধুরি, কবিতা চৌধুরি, বিজলী ঘোষ