বাংলার আসনশিল্পের অন্দর-কথা ৫

অরুণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘রামসুন্দর ত্রিবেদী ও রবীন্দ্রনাথ: বাংলা ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির দুই পথিকৃৎ’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন– “... জোড়াসাঁকো থেকে রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগে বলেন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথের সহযোগিতায় স্বদেশি শিল্প ভাণ্ডারের কাজ আরম্ভ হয়। আত্মশক্তি গড়ে তোলার আয়োজন। বাংলার গ্ৰামেগঞ্জে ছড়িয়ে থাকা দৈনন্দিন আসনশিল্প, কারুশিল্প, বয়নশিল্প, বাসন-কোসনের নমুনা ও সামগ্ৰী সংগ্ৰহ করে প্রদর্শনী গড়ে তোলার কাজ হয়। রবীন্দ্রনাথ রামেন্দ্রসুন্দরের স্বদেশী চেতনা ও স্বনির্ভরশীল দেশজ ভাবনাচিন্তার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন।”
১৪ই অক্টোবর, ১৮৯৭, রামেন্দ্রসুন্দরকে চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ জানাচ্ছেন “... আপনি যদি আপনাদের অঞ্চলের সমস্ত শিল্পজাত দ্রব্যের তালিকা পাঠাইয়া দেন তা আমাদের স্বদেশ ভাণ্ডারের কাজে লাগিবে”। এই প্রসঙ্গ সে’সময়ে ঠাকুর বাড়ির খাতাপত্তরেও পাওয়া যায়। কবিপত্নী মৃণালিনী দেবীর অনুবাদচর্চা খাতার শেষ পরিচ্ছেদে ‘Swadeshi Bhandar (১৮৯৬)–এর বিবরণ আছে। তিনি বর্ণনা করেছেন এভাবে- “The Bhandar aims at being an emporium of products of Indian Arts and Manufacturers. It has already in stock a number of well selected & specimen of textile fabrics, silk , cotton, woolen, turned out of Indian Handlooms and factories. Leather articles (sholopur), Cuttack shoes & slippers; Vase, Cap, Dolls, Joypur white stone, Brass, utensils, Silks, Linenes, Wool, cloth Dhariwas, Ludhiana; clothes for, everyday use.
Soap, Candle, Branch of north-western soap company & Kiser Co. Scissors, Knife, Essence, Scented, Oils of H. Bose.Co., K.C. Bose's Biscuits, common towels, Table Cloth, Shawls etc.
মৃণালিনী দেবী এবং কাদম্বরী দেবী
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে আসনের ব্যবহার হত বেশ ভালোই। তার পরিচয় মেলে ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’ সংগ্ৰহশালায় কাদম্বরীর তৈরি ‘সাধের আসন’-এর প্রদর্শনী-কক্ষে। আসনের রঙ হলদে-কমলা, মাঝের মোটিফ চারকোণা, কোণের চারিদিকে পদ্মপাপড়ির মতো চারটি পাপড়ি। আসনের পাড় বরফির মতো নকশায় মোড়া। আসনটি প্রায় চারমাস ধরে নিজের হাতে বুনে কাদম্বরী দেবী উপহার দেন ‘সারদা মঙ্গল’-এর কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীকে। সাধের আসনে ‘সারদা মঙ্গল’ থেকে শ্লোক উদ্ধৃত করে বুনন করা হয়েছিল–
“হে যোগেন্দ্র! যোগাসনে
ঢুলু ঢুলু দু নয়ানে
বিভোর বিহ্বল মনে
কাহারে ধেয়াও।”
কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী ‘সারদা মঙ্গল’-র নবম সর্গের দ্বিতীয় শ্লোকে আসনের কথা উল্লেখ করেছেন এভাবে–
“তোমার আসনখানি আদরে আদরে আনি
রেখেছি যতন করে চিরদিন রাখিব
এ জীবনে আমি আর তোমার সে সদাচার
সেই স্নেহমাখা মুখ পাশরিতে নারিব।”
বাংলার আসনশিল্পে আর একটি বড়ো ভাগ হল দোরখা আসন। এই দোরখা আসন ঠাকুরবাড়িতেই দেখা যায়। আসনের মাঝ বরাবর সহস্রদল পদ্মের চিহ্ন, পদ্মের পাশে আটটি বহুরং-সমন্বিত ময়ূরের ছবি, চারপাশ নানা কল্কার রেখা রয়েছে। এই আসনটি দুদিকেই ব্যবহার করা হয় বলে একে দোরখা আসন বলা হত।
বাংলার নানা সংস্কৃতির নানা ক্ষেত্রেই ঠাকুর বাড়ির অবদানের সন্ধান মিলবে। বাংলার আসনশিল্পেও ঠাকুরবাড়ির প্রভাব অনস্বীকার্য। একটি পরিবার একটি দেশের সংস্কৃতির ধারা বজায় রেখেছিল। যার মধ্যে আসনশিল্পেরও ভূমিকা কম ছিল না।