বাংলার আসনের অন্দর-কথা ৪

ভারতবর্ষের বিভিন্ন আঙ্গিকের চিত্রকলায় আসনের উল্লেখ রয়েছে। জৈন পুঁথিচিত্রে (৭০০-১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ) সিংহাসনে বসে রাজার জয়কীর্তির বিভিন্ন ছবি দেখা যায়। জৈন পুঁথিচিত্রগুলি বেশিরভাগ লাল বা নীল রঙের। অনুরূপভাবে বাংলার পালযুগের পুঁথিচিত্রে পদ্মাসনে বসা বোধিসত্ত্ব অবলোকিতেশ্বরের চিত্র (১০৮৭) রয়েছে। এর প্রমাণ আমরা পাই সুন্দরবনের রাক্ষসখালি থেকে প্রাপ্ত রাজা ডোম্মনপালের (১১৯৬) তাম্রশাসন ফলকের পিছনে উৎকীর্ণ ‘ললিতা আসনে উপবিষ্ট বিষ্ণু’র রেখাচিত্র থেকে। বাংলার বীরভূমে সপ্তদশ শতাব্দীর পটচিত্রে চৈতন্য ও রাজা রুদ্রপ্রতাপের আসনে বসার ছবিও আমরা দেখেছি।
উনিশ শতকে মেদিনীপুরের জাদুপট বা চক্ষুদান পটে আসন ব্যবহারের ছবি ফুটে ওঠেছে। গিরীশচন্দ্র বেদান্ততীর্থ তাঁর ‘প্রাচীন শিল্প পরিচয়’ গ্ৰন্থে ‘কুথাসন’-এর উল্লেখ করেছেন। ‘কুথা’ অর্থাৎ ‘কন্থা’ বা ‘কাঁথা’। কুথাসন একসময় হাতির পিঠে বা ঘোড়ার পিঠে চড়ার সময় ব্যবহার হত। মুঘল মিনিয়েচারে এই ‘কুথাসন’-এর উপস্থিতি চোখ এড়ায় না। হাতির লোমে শরীর যাতে ঘষা না খায়, তার জন্যই এই আসনের ব্যবহার। বসার সুখপ্রদ ব্যবস্থার জন্য এই আসন। কুথাসনগুলি দেখতে রাজকীয়। নানা উজ্জ্বল রঙের কাপড়, জড়ি, চিকন-সুতো দিয়ে তৈরি করা হত। নকশা দেখে মনে হয়, উন্নতমানের বুনন শিল্পীদের দিয়েই এইসব রাজকীয় নকশা বোনানো হয়েছে। হাতির পিঠে পাতার কুথাসনের ছবিই বেশি। তবে, ঘোড়ার পিঠেও যে কুথাসনের ব্যবহার হত, ছবিগুলি দেখে অনুমান করা যায়। গিরীশচন্দ্র বেদান্ততীর্থর এই গ্ৰন্থ থেকে জানা যায়, রামায়নে সুচিত্রিত ‘ভদ্রাসন’-এর ব্যবহার রয়েছে।
মুঘল অনুচিত্রে কুথাসন
ভারতের চিত্রকলার আরেকটি ভিন্নতর অধ্যায়ের কথা বলে পাহাড়ি বা অন্যান্য লোক-অনুচিত্রগুলি। মানকোট, বাসোলি, কুলু, জম্বু, ভোটি, মান্ডি, কাহলুর, কাম্বা, গুলের, কাংরা ইত্যাদি অঞ্চলের পাহাড়ি অনুচিত্রগুলিতে পদ্মাসন, ব্যাঘ্রচর্মাসন, ছাগাসনের ছবি রয়েছে। এই অনুচিত্রগুলিতে আসনের লোকায়ত নানা বৈশিষ্ট্য ও মিশ্রিত বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। মুঘল মিনিয়েচারের আসনেও এই মিশ্রণের ছাপ স্পষ্ট। এখানে আসনের যে ছবি দেখা যায়, সেগুলিতে আরব, আরাকানের মিশ্রিত নানা শৈলী, নকলাবা মোটিফের ব্যবহার রয়েছে।
পাহাড়ি অনুচিত্রে সিংহাসন
প্রাচীনকালে মানুষের গাছের পাতা, পশুর ছাল দেহ আবৃত করার উপাদান হলেও সভ্যতার অগ্ৰগতির সঙ্গে বাসস্থান, বসা ও শোওয়ার জন্য নানা বস্ত্র বা আসনের ব্যবহার দেখা গেল। পশুদের মাংস খাদ্য হিসাবে বিবেচিত হওয়ার পর তারা পশুর চামড়া শীত নিবারণের জন্য কিংবা বিছানা বা আসনের জন্য ব্যবহার করা শুরু করেছিল।
পাহাড়ি অনুচিত্রে ছাগাসন
তার প্রমাণ আমরা পাই, বিভিন্ন পাহাড়ি অনুচিত্রে, যেমন- কালী বসে আছেন ছাগাসনে, ব্যাঘ্রচর্মাসনে উপবিষ্ট শিব কিংবা পার্বতির পাশাখেলার দৃশ্য ইত্যাদিতে। এছাড়া, বাংলার আলপনায়, সরাচিত্রে, বীরভূমের চৌকশপটে (বিশ শতক), মুর্শিদাবাদ শৈলীর (১৭৬০) ছবিতে, মেদিনীপুরের পটচিত্রে আসনের ছবি রয়েছে। আধুনিক চিত্রশিল্পীদের চিত্রপটেও আছে আসনের নানা ছবি।;
আধুনিক চিত্রকরের ছবিতে-- প্রকৃতিজাত আসন
ভারত উপমহাদেশে তথা বাংলায় লৌকিক বা সামাজিক জীবনে আসন যে অপরিহার্য ছিল, তা বোঝা যায়। তাছাড়া, অতিথি-সম্ভাষণে ভারত তথা বাংলা আজও বিশ্বের নিরিখে প্রথমে রয়েছে। সেই অতিথি-সম্ভাষণের অন্যতম উপাদানও যে এই আসন।