No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    বাংলার আসনশিল্পের অন্দর-কথা ৩

    বাংলার আসনশিল্পের অন্দর-কথা ৩

    Story image

    বাংলার অনেক গ্ৰাম ঘুরে আসন দেখতে দেখতে মনে হয়েছে মাধ‍্যম, পদ্ধতি, বুনন ইত‍্যাদি কারণে আসনশিল্পকে নানা ভাগে ভাগ করা যায়। আগের লেখাতেই সেই প্রকারভেদগুলির নামোল্লেখ করেছিলাম। এবার সংক্ষেপে তাদের পরিচয় দেওয়া যাক। 

    সাধারণ আসন: বাংলার ঘরে ঘরে রোজ যে সমস্ত আসন ব‍্যবহৃত হয়, সেগুলির মধ‍্যে প্রকৃতিজাত আসনগুলি হল– মাদুরের আসন, খেজুরপাতার আসন, শীতলপাটির আসন, তাল ও নারকেল পাতার আসন, তালপাতার চাটাই, খেজুরপাতার চাটাই, সুচিশিল্পাসন, পাটের আসন, ছিটকাপড়ের আসন, পুরনো কাপড়ের আসন ইত‍্যাদি।

    ধর্মীয় আসন: বহুবিধ সংস্কারে আবদ্ধ বাঙালি। আমাদের দশ-সংস্কার (বিবাহ, গর্ভধান, পুংসবন, সীমান্তোয়ন, জাতকর্ম, অন্নপ্রাশন, চূড়াকরণ, উপনয়ন ও সমাবর্তন) পালনে বাঙালির আচার অনুষ্ঠানের প্রয়োজন হয়। এই দশসংস্কার পালন করতে অনেকগুলি উপাচারের প্রয়োজন হয়। পুজোর ষোড়শ-উপাচারের প্রথম উপাচারই হল আসন।

    পুজো বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ব‍্যবহৃত আসনগুলি হল– কুশাসন, কম্বল আসন, আলপনার আসন, পিঁড়ে, ডায়নামাজ (নামাজ পড়ার আসন) ইত‍্যাদি। আলপনার আসন দুই ভাগে ভাগ করা যায় যথা– পঞ্চগুড়ির আসন ও কাষ্ঠাসন বা পিঁড়ে। পুজোর সময়  ব্রাহ্মণ আসনেই উপবেশন করেন।

    উৎসব বা অনুষ্ঠানের আসন: বাঙালির ঘরে নানা লৌকিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা উৎসবে অতিথিদের বসার জন‍্য যেসব আসনের প্রয়োজন হয় সেগুলি হল– কাঁথা আসন, খাটকাঁথা, কীর্তনের আসন, বিবাহের আসন, অন্নপ্রাশনের আসন, সাধভক্ষণের আসন ইত‍্যাদি।

    সূচিশিল্পাসন: নকশা ও বুননের নিরিখে সূচিশিল্পাসন মাধ‍্যমগত দিক থেকে আলাদা। এখানে বুননের পদ্ধতিগুলি ভিন্ন ভিন্ন রকমের হয়। মহিলারা অবসর সময় কাটানোর জন‍্যে এ ধরনের সুচিশিল্পাসনগুলি তৈরি করতেন। অনান‍্য আসনগুলির থেকে  বেশি সময় ধরে এগুলি বোনা হত। নকশাগুলি কখনো নেওয়া হত আলপনা থেকে, কখনো বা কল্পনা থেকে। আর এই নকশা বোনার ইতিহাস বংশ-পরম্পরায় বিকশিত হয়েছে। নানা প্রজন্ম ধরে মা থেকে মেয়েতে নকশাগুলির স্নেহ বিস্তার ঘটেছে। মোটিফগুলি নানা আঞ্চলিকতার প্রভাবে রাপান্তরিত হয়েছে নানা সময়ে। হিন্দু পাড়া-গাঁতে একরকম আবার মুসলিম পাড়াতে তার শৈলীর বিস্তার ঘটেছে অন্যভাবে। নানা অনুষঙ্গ এসে মিশেছে এই বুননে। বাঙালি মহিলাদের সূচিশিল্পাসন নিয়ে স্মৃতিমেদুরতা রয়েছে। সেই স্মৃতিমেদুরতা স্বাভাবিক। কারণ, বহু প্রজন্ম ধরে বিকশিত হয়েছে সূচিশিল্পাসন। সূচিশিল্পাসনের ভাগগুলি হল– বিবাহের আসন বা বর আসন, ধর্মীয় আসন, বিনোদনের আসন, সাধভক্ষণের আসন, প্রকৃতি-বিষয়ক নকশা আসন, জ‍্যামিতিক নকশা আসন, দৈনন্দিন বস্তুনির্ভর নকশা আসন, কাঁথা আসন, রুমালাকৃতি আসন ইত‍্যাদি।

    সূচিশিল্পাসনের মোটিফ ও ফোড়:

    বাংলার আসনের প্রধান নকশা বা মোটিফগুলি হল– কলমিলতা, বকুলফুল, কানামাছি, চালদাফুল, ধূপদানি, আপেল, আঙুরফল, তারাফুল, বরফি, ধানছড়া, ঝাড়বাতি, পদ্ম, নারকেলফুল, সীতাদুল, গোলাপ, পান, শিকল, গরুর গাড়ির চাকা, প্রজাপতি, স্বস্তিকাফুল, ঘট বা কলস, টিয়াপাখি, হাতি, ঘোড়া ইত‍্যাদি।

    আসনের ফোড়সমূহ: আসনের ফোড়গুলি হল– এলো ফোড়, মাকড়া ফোড়, বিছে ফোড়, বস্তা ফোড়, চিকে ফোড়, আনারসের চোখ ইত‍্যাদি। 

    আলপনার সঙ্গে আসনের সাদৃশ‍্য: বাংলায় মুসলিম-ধর্মান্তকরণ ঘটল দ্বাদশ শতাব্দী থেকে। ধর্মান্তকরণের ফলে বাংলার নারীদের ধর্ম হয়তো বদলাল ঠিকই, কিন্তু বাংলার ঐতিহ‍্য, লৌকিক সংস্কার তারা ভোলেননি। আলপনার পরির্বতে তারা বুনলেন কাঁথা, আসন ইত‍্যাদি। ফলে, আসনে বা কাঁথায় উঠে আসতে লাগল আলপনার মোটিফগুলি। অপরদিকে, হিন্দু মেয়েদের আসনেও উঠে আসতে লাগল আরবি মিনাকারির মোটিফ, ফুলপাতা, নকশার পাশাপাশি তাজমহলের ছবি বা মোটিফ। এইসব মোটিফের ব্যবহার বা জন্ম ধর্মের সীমা অতিক্রম করেই।

    লক্ষ্ণীপুজোয় দেওয়া দোপাটি লতা, কলমিলতা, সেঁজুতিব্রতের বাড়ি, সুবচনী ব্রতের হাসের পাশে থাকা আলপনাটি, ধানের ছড়া কিংবা বৌ-পরিচয়ের পান-সুপারির আলপনা, জোড়া পদ্ম, তারা ব্রতের আলপনা (ভূমন্ডল), টরঞ্চলতা, স্বর্ণপৈঁছা ইত‍্যাদি আলপনাগুলি আসনের মোটিফ হিসাবে উঠে এসেছে নানা সময়ে। আসনে আলপনার মোটিফগুলি সহজেই বোঝা যায়। বিভিন্ন ধর্মীয় বা লৌকিক অনুষ্ঠানে আলপনাগুলি দিয়েছেন বা দেখেছেন। ধর্মান্তকরণ হলেও সেই আলপনাগুলিকে তারা ভুলতে পারেননি।  কিংবা হয়তো সামাজিক ঐতিহ্যের অবচেতনেই তা গাঁথা হয়ে ছিল। যার কারণে, আসনের বিষয় হয়ে উঠেছে আলপনা। এভাবে মাধ‍্যম-পরিবর্তনের ফলে একটা বিষয় খুব পরিষ্কার যে, আলপনাগুলির স্থায়ীকরণ ঘটল। যে আলপনা ক্ষণিকের ছিল, তা আসনে বা কাঁথায় বছর বছর ধরে রয়ে গেল।

    (ক্রমশ)

    আসনশিল্পী: উমা দাস

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @