বাংলার আসনের অন্দরের কথা ১

“এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা মধ্যিখানে চর
তারি মধ্যে বসে আছেন শিব সওদাগর
শিব গেলেন শ্বশুরবাড়ি বসতে দিল পিড়ে
জলপান করতে দিল শালিধানের চিঁড়ে”
বাংলার লোকমানস থেকে উঠে আসা এই কবিতাটি। এই লোককবিতাটিতে বাংলার আপ্যায়নের সৃজন মৌলিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। এখানে পিঁড়ি মানে কাষ্ঠাসন। পিঁড়ির বিবর্তিত রূপ হল সূচীশিল্পাসন। বারো মাসে তেরো পার্বনের দেশে বাঙালির আড্ডা-অনুষ্ঠানে কুটুম আসার শেষ নেই। কুটুম আসাকে কেন্দ্র করে বাঙালির রয়েছে অজস্র সংস্কৃতি। কুটুমকে যত্ন করে বসানোর জন্যে রয়েছে আসন। আসনকে সুতো বা উল দিয়ে সুন্দর নকশার মাধ্যমে অতিথিদের কাছে তুলে ধরা, নারীমনের নান্দনিক উপস্থাপনা। পিঁড়িকে কেন্দ্র করে রয়েছে পিঁড়িচিত্র। বাঙালির আপ্যায়নের শৈল্পিক বহিঃপ্রকাশের মধ্যে এক হল এই আসন।
ছোটোবেলায় গ্ৰামের মহিলাদের দেখেছি সংসারের নানা কাজকর্ম করার পরেও তারা আসন বুনত। নানা রঙের সুতো দিতো দিয়ে বুনতেন নকশিকাঁথা। হয়তো সুপ্ত অবস্থায় লুকিয়ে থাকা নানা নকশাগুলি কাঁথায় বুনতেন তারা। স্নাতকস্তরে পড়ার সময় কৌতূহলী হয়ে লক্ষ্য করলাম আসনে ব্যহৃত নকশাগুলির সঙ্গে ব্রত আলপনার সাদৃশ্য আছে। পরবর্তীকালে মাঠ-গবেষণার সুবাদে আসন-মোটিফের পিছনে লুকিয়ে থাকা নানা রহস্যের কথা উঠে এসেছে। নানা ছড়িয়ে থাকা তথ্য, ছবি নকশাগুলি একত্র করার চেষ্টা এখনও চলছে। লোকসংস্কৃতিবিদ সুধীর চক্রবর্তীর কথা ধরে বলতে হয়– “লোকশিল্পের মূল ভিত্তি হচ্ছে আত্মপ্রত্যয়, জন্মার্জিত সংস্কার, দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যবাহিত শিল্পবোধ”।
এখনও বিভিন্ন গ্ৰামে ঘুরে ঘুরে দেখেছি গ্ৰামীণ নারীসমাজ স্বামীকে সুখী রেখে, ছেলে মেয়ে মানুষ করে, শ্বশুর-শাশুড়ি, পরিবারবর্গকে দেখাশোনা কর রাতের পর রাত জেগে, কাঁথা, আসন তৈরি করেছেন। সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া, তথাকথিত পড়াশোনা না জানা মহিলারা অদ্ভুত এক দর্শনের জন্ম দিয়েছেন-- যা হয়তো লোকদর্শনই।
পশ্চিমবঙ্গের তথা বাংলাদেশের একটি লুপ্তপ্রায় লোকশিল্প হল এই আসন। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম গ্ৰন্থ ‘চর্যাপদে’ ও পিঁড়ির (কাষ্টাসন) উল্লেখ রয়েছে।
“ভণই লুই আহ্মে সানে দিঠা
ধমন চমন বেণি পান্ডি বইঠা।”
আরও পড়ুন
ছুঁচ-সুতোয় গল্প বোনা আছে যে সংগ্রহশালায়
পান্ডি মানে পিঁড়ি। চর্যাপদের সময়কাল খ্রিষ্টীয় সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী। অনুমান করা যায়, সপ্তম বা তার আগে থেকেই বাংলায় কাঠের আসন বা পিঁড়ির প্রচলন ছিল। বাংলার ব্রতকথায় দুটি আসনের উল্লেখ আছে। যদি আমরা ব্রতকথাকে প্রাচীন বলে মনে করি তাহলে আলপনার আসন খুবই প্রাচীন। কারণ, জাতকের গল্পে ব্রতের উল্লেখ রয়েছে। তাহলে সেই সময়ে আলপনার আসন ছিল আমরা অনুমান করতেই পারি। আমরা জানি গৌতম বুদ্ধের জন্ম হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৫৬৩-তে আর জাতকের কাহিনি আরো আগের কথা বলে। এখান থেকে বোঝা যায়, বাংলায় আসনের ব্যাপ্তি অনেক প্রাচীন। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বঙ্গীয় শব্দকোষে উল্লেখ করেছেন-- আসন মানে উপবেশন, স্থিতি, অবস্থান, উপবেশনার স্থান ইত্যাদি।
আসন অঙ্গুরি–আসন অঙ্গুরীয় পুজোর উপাচার বিশেষ।
আসন বদ্ধ-আসন রূপ বন্ধ বা স্থিতি বিশেষ।
(চলবে)