দেড়শো বছরের পুরোনো বাংলাদেশের সবথেকে বড়ো বইয়ের বাজার ঢাকায়!

কলকাতায় আমরা বইপাড়া বলতে যেমন কলেজ স্ট্রিটকে বুঝি, তেমনই ঢাকার বইপাড়া হল বাংলাবাজার। বইপাড়া না বলে বইয়ের রাজ্য বলাই হয়তো বেশি যুক্তিযুক্ত হবে, কারণ সমস্ত বাংলাদেশের সবথেকে বড়ো বইয়ের বাজার এটি। গোটা দেশে বইয়ের ব্যবসা আবর্তিত হচ্ছে এই জায়গাকে ঘিরে। বাংলাদেশের নামাজাদা সব প্রকাশনারই অফিস রয়েছে এখানে। নতুন নতুন পাঠ্যপুস্তক এবং সৃজনশীল-মননশীল বই তো আছেই। পাশাপাশি, পুরোনো বইয়ের ভাণ্ডারও যথেষ্ট লোভনীয়। এই জায়গাতে বই ছাপানো-বাঁধানোর কাজও হয়। অক্ষরবিন্যাস, মুদ্রণ, পেস্টিং, বাঁধাই, ল্যামিনেশন, তারপর সেই বই দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে দেওয়া, নিত্যদিন এভাবেই বাংলাবাজারের জীবন বয়ে চলে। এক গলির থেকে আরেক গলি, তার মধ্যে সার সার বইয়ের দোকান, বইয়ের গন্ধ – এরই মধ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষের রুজি-রোজগার মেলে।
ব্যবসাবাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে বাংলাবাজার গড়ে উঠেছিল অনেক অনেক দিন আগে, সেই সুলতানি আমলে। ঢাকা শহর গড়ে ওঠার আগেই বেশ গমগমে জায়গা ছিল এটি। বেশ কিছু গবেষক মনে করেন, একটা সময়ে এই অঞ্চল ‘বাঙ্গালা’ শহরের কেন্দ্রস্থল ছিল। মধ্যযুগের অনেক অভিযাত্রীদের লেখায় ‘বাঙ্গালা’ শহরে নাম পাওয়া যায়। সুলতানি যুগে এই শহর হয়ে উঠেছিল রেশম এবং সুতো তৈরির জন্য বিখ্যাত। ব্রিটিশ আমলে বেশ কিছু ইংরেজ সরকারি কর্মচারী এবং বণিক এখানে বসবাস শুরু করেন। বাংলাবাজার এলাকা টাকা-পয়সা ভাঙানোর জায়গা হিসেবে বিখ্যাত হয়ে ওঠে। ১৮৬০ সালে ঢাকায় বসল ‘বাঙ্গলা যন্ত্র’, মানে ছাপাখানা। এদিকে কলকাতার বটতলা সাহিত্যকে অনুসরণ করে ঢাকার চকবাজারে মুসলিম পুঁথি ছাপা হতে লাগল, গড়ে উঠল কেতাবপট্টি।
১৮৫৭ সালে মহাবিদ্রোহের পর বাংলাবাজারে আস্তে আস্তে বইয়ের দোকান চালু হতে লাগল। তখন বই ছাপা হত বাবুবাজারে। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ এবং ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকে ঘিরে পূর্ববাংলায় এক সাংস্কৃতিক জাগরণ শুরু হয়। ওই সময় থেকে বাংলাবাজার হয়ে ওঠে কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী-গবেষকদের আড্ডা মারার একটা জায়গা। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ হল। মল্লিক ব্রাদার্সের মতো বেশ কিছু প্রকাশক কলকাতা থেকে ব্যবসাপত্র উঠিয়ে বাংলাবাজারে দোকান খুলল। এর সঙ্গে সঙ্গে জন্ম নিল একঝাঁক নতুন প্রকাশনা সংস্থা – নওরোজ কিতাবিস্তান, স্টুডেন্ট ওয়েজ, গ্রেট ইস্ট লাইব্রেরি, আল হামারা লাইব্রেরি, মালিক লাইব্রেরি, খোশরোজ কিতাব মহল, হার্ডসন অ্যান্ড কোম্পানি, পুঁথিপত্র এবং আরও অনেক। এই প্রকাশনাগুলোর যাঁরা কর্ণধার, তাঁদের বেশিরভাগই ছিলেন সৃজনশীল মানুষ। যেমন, নওরোজ কিতাবিস্তানের মালিক ছিলেন শিশুসাহিত্যিক মোহাম্মদ নাসির আলী কিংবা আল হামারা লাইব্রেরির মালিক ছিলেন কবি মঈনুদ্দিন। এখন বাংলাবাজারে চারশোর বেশি প্রকাশনা সংস্থা আর প্রায় দু’হাজার বইয়ের দোকান রয়েছে।
তথ্যসূত্র – প্রথম আলো, নয়া দিগন্ত।