No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    বনধের চৈত্র সেল

    বনধের চৈত্র সেল

    Story image

    বিগত ১৩ এপ্রিল দিনটি বাঙালি জীবনে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। দিনটি এমনিতে জালিয়ানওয়ালাবাগ দিবস। তাছাড়া সেদিন ছিল নীলযাত্রা। এইসব পরবকে তুচ্ছ করে দিনটি এরপর থেকে পালিত হবে বাঙালি বামেদের বোধোদয় দিবস হিসেবে। বুর্জোয়া গণতন্ত্রের ছেনালির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে সেদিন বামেরা ছয় ঘণ্টার বনধ ডেকেছিল। পঞ্চায়েত ভোটে মনোনয়ন জমা দিতে না পারার বিরুদ্ধে আপোসহীন প্রতিবাদ এবং বাস্তববোধের এক আগমার্কা ককটেল উপস্থিত করে তাঁরা বুঝিয়ে দিয়েছেন যে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সংগ্রামের পতাকা কেমন করে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে হয়।

    প্রথামাফিক এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে যথাসময়ে বামফ্রন্টের সভা ডাকা হয় আলিমুদ্দিনে। ঘড়ি ধরে একে একে এগিয়ে আসছেন পদব্রজ বসু, দিবাকর মিশ্র, নিদ্রাহরণ চক্রবর্তী, লম্ফমান মাহাতো, কীটদষ্ট মুখুটি, কুম্ভকর্ণ নন্দ, জহুরী চাটুজ্যে এবং আরও অনেকে। রাজনৈতিক দলগুলির বেঁচে থাকার গোড়ায় হল জনসমর্থন। সেই হিসেবে আধপেটা খেয়েও যে বামফ্রন্টের ঐক্য অক্ষুণ্ণ আছে – সেকথা মানতেই হবে। বালবাচ্চা মিলিয়ে সেই পরিবারের সদস্য সংখ্যা হল ১৭। যদিও পরিবারের কর্তা পদব্রজবাবু একদম অকৃতদার।

    সামনে পেয়েই বড়কর্তাকে প্রশ্ন করলুম – বুর্জোয়া গণতন্ত্রে ৩৪ বছর টিকে গেলেন কেমন করে?
    - বামপন্থীদের হাতেই বুর্জোয়া গণতন্ত্র সবচেয়ে সুরক্ষিত।
    - তাহলে হারলেন কেন?
    - নির্বাচন অবাধ করেছিলাম বলে হেরেছি।
    - জনগণ মুখ ফেরাল কেন? 
    - দলে বেনোজল ঢুকেছিল।
    - সেটা আটকাতে পারলেন না?
    - বন্যা নিয়ন্ত্রণ খুবই কঠিন কাজ।

    সভার শুরুতে পদব্রজ বনধের ইতিহাস তুলে ধরলেন। ফ্রন্টে তিনি সবচেয়ে সম্মানিত। পায়ে হেঁটে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছোতে বিনোবা ভাবে-র পর তিনিই দ্বিতীয়। আগে দেশবন্ধু পার্ক থেকে দেশপ্রিয় পার্ক পর্যন্ত পদযাত্রা হত। এখন ধর্মতলা থেকে তারামণ্ডল পর্যন্ত। সময় বদলেছে। তাই সংগ্রামের হাতিয়ারও বদলেছে। মানুষের ব্যস্ততার জন্যই উপন্যাসের বদলে ছোটগল্পের আবির্ভাব। পাঁচ দিনের ক্রিকেট ম্যাচের স্থান নিয়েছে টি-২০।

    আগে ৭২ ঘণ্টার বনধ ডাকা হত। সেই বনধ সফল করার জন্য কেরানিকুলের কমরেডরা সাতদিন আগে থেকে লোকাল ট্রেনে বাচিক প্রচার চালাতেন। ওই তিনদিন আর বাইরে বেরনো নয়। কী থেকে কী হবে, কে জানে! সেই প্রচার মানুষের মনে ধরত। ২৪ ঘণ্টার বনধ ছিল জলভাত। অন্ধ্রে রামা রাও সরকারের পতন ঘটলে, সেই রাজ্যে বনধ হোক ছাই না হোক, পশ্চিমবঙ্গ অচল হবেই। বামপন্থীদের সেই ভারতবোধের জন্য গর্বে বুক ফুলে উঠত।

    নিদ্রাহরণ চক্রবর্তী জানেন, পদব্রজ সহজে থামার পাত্র নন। তিনি জানালেন, এবারের বনধের কথায় আসা যাক। আমাদের হাতে সময় কম। বনধ সফল করার ব্যাপারে তাঁর পারদর্শিতা সকলেই জানেন। ট্রামে কি করে আগুন ধরাতে হয় সেই প্রযুক্তিতে তাঁর অঘোষিত পেটেন্ট ছিল। তিনি আসলে শ্রেণীশত্রুদের নিদ্রাহরণ করতেই নিজেকে নিয়োজিত করতেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আরও অনেকের ঘুম চটকে দিত।

    ফ্রন্টে সকলেরই কথা বলার অধিকার। সাধারণত কথা হয় একটাই কিন্তু তা ১৭ মুখে ঘুরতে থাকে। এবারে কঠিন অগ্নিপরীক্ষা। সামনে চৈত্র সংক্রান্তি, পয়লা বৈশাখ, পঞ্চায়েত ভোট, লোকসভা নির্বাচন। ফলে এমনভাবে বনধ ডাকতে হবে যাতে জনগণ বিরক্ত না হয়। জনগণকে কাছে টানাই এখন প্রধান কাজ। পরিস্থিতির গুণগত মান মেপে নিয়েই বিপ্লবী পদক্ষেপ স্থির হয়। ধীরে ধীরে আলোচনাটা শ্বাসরোধকারী গাম্ভীর্য অর্জন করে। মনে হয় ১৯১৭-র ৬ নভেম্বর কমরেড লেলিন এমন করেই পরিস্থিতির চুলচেরা বিচার করেছিলেন। পরের দিন যাতে পৃথিবীতে অন্য ইতিহাসের সূচনা হয়।

    বনধ কত ঘণ্টার হবে? বালবাচ্চা শরিকরা ২৪ ঘণ্টা ২৪ ঘণ্টা বলে চেঁচাতে শুরু করল। তারা জানে বনধ সফল হলে বাহবা পাবে পদব্রজ আর দিবাকর। ব্যর্থ হলেও গাল খাবে তারাই। ফলে বিপ্লবীয়ানা প্রদর্শনে তারা পিছিয়ে থাকবে কেন? পার্টি ছোট হলেও তারা তো ফেলনা নয়।

    দিবাকর মিশ্র বাস্তব পরিস্থিতি বোঝাতে গিয়ে বললেন, পার্টি কংগ্রেসে হাজিরা দিতে গোয়াল খালি হয়ে যাচ্ছে। ফলে পরিস্থিতির মোকাবিলার জন্য পরীক্ষিত কমরেডে টান পড়বে। কীটদষ্ট মুখুটি ১২ ঘণ্টার প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু লম্ফমান মাহাতো ২৪ ঘণ্টায় অনড়। অনেক টানাপোড়েনের পর দেখা গেল ১২ ঘণ্টার নিচে কেউ নামতে চাইছেন না। জহুরী চাটুজ্যে বললেন তার নিচে নামলে জাত থাকে না। বাপ-ঠাকুরদার পথ বেমালুম ভুলে যাওয়া ঠিক নয়। এই সময় চেয়ারে এপাশ থেকে ওপাশ হয়ে কুম্ভকর্ণ নন্দ জানালেন এখন চৈত্রসেল চলছে। তাহলে বনধেই বা আমরা ডিসকাউন্ট দেব না কেন? জনগণ হল মার্কেট আর পলিটিকাল পার্টিগুলো হল কমোডিটি। বলেই তিনি আবার চোখ বুজলেন।

    ধরাবাঁধা বুলি কপচাতে কপচাতে যাঁদের মুখে অরুচি এসে গেছে এই ঘোষণায় তাঁরা একটু চাটনির স্বাদ পেলেন। বিগ বাজারেও একমাস ধরে ৫০% ছাড়ের ঘোষণা ঝুলছে। ইঁদুরকল থেকে বেরনোর জন্য পদব্রজ কথাটা লুফে নিলেন। প্রতিবাদ হল আসলে প্রতীক। দেবতার প্রসাদকে যেমন বলা হয় কণিকা মাত্র। বামেদের সর্বশেষ বনধটি ছিল ১২ ঘণ্টার। এবার আমরা স্বচ্ছন্দে ৫০% ছাড় দিতে পারি। ১৩ এপ্রিল আমরা ৬ ঘণ্টার বনধে যাব। যাতে শ্রমজীবী মানুষের চৈত্রসেল কোনওভাবে ব্যাহত না হয়। গরিবের পেটে লাথি মারা আমাদের কাজ নয়। বড়কর্তা জানালেন ১৩ এপ্রিল বাম আন্দোলনে মাইলস্টোন হয়ে থাকবে।

    কিন্তু কোন ছয় ঘণ্টা? জহুরী চাটুজ্যে জানালেন বনধ তার নিয়ম মতোই সকাল ছ’টায় শুরু হবে। তার ফলে বেলা বারোটার মধ্যে বিপ্লবের কীর্তন শেষ। তারপর থেকে চৈত্রসেলের ভরা বাজার। বাজার মানেই জনগণ।

    এবার কুম্ভকর্ণের নিদ্রা ভঙ্গ হল। তিনি বললেন জনহিতৈষণার এই উদাহরণ মাত্র একদিন পালন করলে চলবে না। আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাতেও তার ছাপ থাকা দরকার। বাজার আর উৎপাদন বন্ধ করে আমরা বনধ ডাকব না।

    কীটদষ্ট মুখুটি জানালেন তাহলে সবচেয়ে নিরাপদ হল মধ্যরাতে বনধ ডাকা। সকলকে চমকে দিয়ে প্রস্তাবটা লুফে নিলেন নিদ্রাহরণ চক্রবর্তী। তিনি হরতালদা বলেই সমধিক পরিচিত। কিন্তু এখন ধকল শরীরে সয় না। জনগণের দুর্গতি না করে বনধ ডাকার মাহেন্দ্রক্ষণ হল রাত বারোটা থেকে সকাল ছ’টা। এমনিতেই জল, দুধ, হাসপাতাল, নার্সিং হোম, ওষুধের দোকান, দমকল, অ্যাম্বুল্যান্স, মিডিয়া বনধের আওতার বাইরে থাকে। ছাড়ের তালিকায় আর কী ঢোকানো যায় সেটা পরে ভাবা হবে। রণকৌশলগত ভাবে এই বনধ ডাকার উপযুক্ত সময় হল মাঘ মাসের মধ্যরাত।

    বনধের দিন কাকভোরে নিদ্রাহরণের মোবাইল বেজে উঠল। কাজের মেয়ে ফেতু জানাল, আজ বাংলা বনধ। সোনা বৌদিকে বোলো আজ কাজে যাবোনি।

    নিদ্রাহরণ মনে-মনে হেসে বললেন, পরের বনধে কীভাবে ফাঁকি দিস দেখব।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @