No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    উনিশ শতকে মেয়েদের একমাত্র কাগজ ছিল ‘বামাবোধিনী’ 

    উনিশ শতকে মেয়েদের একমাত্র কাগজ ছিল ‘বামাবোধিনী’ 

    Story image

    উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে স্ত্রীশিক্ষার বিষয়টি খুব বেশি লোকের সমর্থন পায়নি। ১৮৬৩ সালে উমেশচন্দ্র দত্ত (১৮৪০-১৯০৭) বিবাহিত মহিলাদের শিক্ষিত করে তোলার চেষ্টায় মুক্তমনের কিছু ব্রাহ্ম নেতাদের নিয়ে 'বামাবোধিনী সভা' গড়ে তোলেন। বই ও পত্রিকা প্রকাশ করা এবং উক্ত বিষয়ে বিবিধ রচনা প্রকাশ করে জনমত তৈরি করাও ছিল একটি উদ্দেশ্য। ১৮৪৯ সালে বেথুন স্কুল স্থাপিত হয়েছিল। ১৮৬৩ সালে বালিকা বিদ্যালয়ের সংখ্যা সমগ্র বাংলায় তখন ছিল ৩৫টি এবং ১১৮৩ জন বালিকা তাতে ভর্তি হয়েছিল। বামাবোধিনী সভার সদস্যরাই ১৮৬৩ সালের আগষ্ট মাসে (১২৭০ বঙ্গাব্দের ভাদ্র) 'বামাবোধিনী পত্রিকা' নমে একটি মাসিক পত্রিকার প্রকাশ শুরু করে। পত্রিকাটি প্রকাশিত হত কলকাতার সিমুলিয়ায় ১৬নং রঘুনাথ স্ট্রিটের বামাবোধিনী সভার কার্যালয় থেকে। মহিলাদের যাবতীয় প্রয়োজন মেটাবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এর প্রকাশনা শুরু হয়। সব ধরনের কুসংস্কার দূর করে মেয়েদের শিক্ষিত করে তোলার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরত পত্রিকাটি।

    প্রথম সংখ্যার শীর্ষদেশে লেখা ছিল –“বামাবোধিনীতে ভাষাজ্ঞান, ভূগোল, ইতিহাস, জীবন চরিত, বিজ্ঞান, স্বাস্থ্যরক্ষা, নীতি ও ধর্ম, দেশাচার, পদ্য, গৃহচিকিৎসা, শিশুপালন, শিল্পকর্ম্ম, গৃহকার্য্য ও অদ্ভুত বিবরণ প্রকাশিত হইবে।” প্রথম কয়েক সংখ্যায় না থাকলেও পরে প্রথম পৃষ্ঠাতেই একটি সংক্ষিপ্ত পঞ্জিকা প্রকাশিত হত। ২য় থেকে ২০ সংখ্যায় পত্রিকার কণ্ঠদেশে চার পংক্তির এক একটি কবিতা প্রকাশিত হত। ২য় সংখ্যার কবিতাটি ছিল – 

    “সকলের পিতা যিনি করুণানিধান।
    নর নারী প্রতি তাঁর করুণা সমান।।
    জ্ঞান ধর্ম্মে উভয়ের দিয়াছেন মন।
    নয়ন থাকিতে অন্ধ কেন বামাগণ?” 

    ৩য় সংখ্যায় ছিল -

    “চিরদিন পরাধীন কারাবাসি-প্রায়,
    একেতে অবলা হায় জ্ঞানহীনা তায়।
    মানুষ হইয়া অন্ধ পশুমত রয়,
    নারীর সমান দীন ভারতে কে হয়?”
    এরপরে ১২৭২ বঙ্গাব্দের বৈশাখ সংখ্যা থেকে কবিতার পরিবর্তে একটি মাত্র শ্লোক মুদ্রিত হত; সেটি ছিল —

    “কন্যাপ্যেবং পালনীয়া শিক্ষণীয়াতিযত্নতঃ।” দেবনাগরী অক্ষরে লিখিত শ্লোকটির নীচেই থাকত তার বঙ্গানুবাদ -

    “কন্যাকে পালন করিবেক ও যত্নের সহিত শিক্ষা দিবেক।”

    পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যায় উপক্রমণিকা থেকে কিছু অংশ নিচে উদ্ধৃত করা হল। এর থেকে পত্রিকা প্রকাশের উদ্দেশ্য কিছুটা বোঝা যাবে।

    “ঈশ্বর প্রসাদে এক্ষণে এদেশের অবলাগণের প্রতি অনেকের দৃষ্টি পড়িয়াছে। পুরুষদের ন্যায় তাহাদের শিক্ষাবিধান যে নিতান্ত আবশ্যক, তদ্ভিন্ন তাহাদের দুর্দ্দশার অবসান হইবে না, দেশের সম্যক মঙ্গল ও উন্নতির সম্ভাবনা নাই; ইহাও অনেকে বুঝিয়াছেন। আমরা দেখিতে পাই এই উদ্দেশ্যে দেশহিতৈষি মহোদয়গণ স্থানে স্থানে বালিকা বিদ্যালয় সকল স্থাপন করিতেছেন, দয়াশীল গবর্ণমেণ্টও তদ্বিষয়ে সহায়তা করিতেছেন। কিন্তু এ উপায়ে অতি অল্প সংখ্যক বালিকারই কিছু দিনের উপকার হয়। অন্তঃপুর মধ্যে বিদ্যালোক প্রবেশের পথ করতে না পারিলে সর্ব্বসাধারণের হিতসাধন হইতে পারে না।”

    “এই পত্রিকাতে স্ত্রীলোকদিগের আবশ্যক সমুদয় বিষয় লিখিত হইবে। তন্মধ্যে যাহাতে তাহাদের ভ্রম ও কুসংস্কার সকল দূর হইয়া প্রকৃত জ্ঞানের উদয় হয়, যাহাতে তাদের উৎকৃষ্ট মনোবৃত্তি সকল উপযুক্ত বিষয়ে পরিচালিত হয়, এবং যাহাতে তাহাদের নিতান্ত প্রয়োজনীয় জ্ঞান সকল লাভ হইতে পারে, তৎপ্রতি বিশেষ দৃষ্টি থাকিবে। ইহাতে যে সকল বিষয় অবলম্বন করিয়া লেখা হইবে, পত্রিকার শিরোভাগে তাহার উল্লেখ করা গিয়াছে।”

    বামাবোধিনী পত্রিকা’র প্রথম সংখ্যায় যে রচনাগুলি ছিল সেগুলি হল : উপক্রমণিকা; স্ত্রীলোকদিগের বিদ্যাশিক্ষার আবশ্যিকতা; ভূগোল; বিজ্ঞান (জল বহুরূপী); স্বাস্থ্যরক্ষা (গৃহ পরিস্কার) ও নীতি উপদেশ (কবিতা)। মেয়েদের জড়তা সবে ভাঙতে শুরু করেছে, তাদের দুরবস্থা বর্ণনা এবং শিক্ষিত করে তোলার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে অনেকে লিখতেন। মেয়েরাও কিছু কিছু লেখা প্রকাশ করে তাদের মতামত জানাতেন। তবে অনেক সময়ে পুরুষেরাই মেয়েদের নামে লেখা পাঠাতেন স্ত্রীলোকদের করণীয় নির্দিষ্ট করে এবং প্রয়োজনীয় উপদেশ দান করে। সে কারণে ‘বামাবোধিনী’ অনেক সময়ে সঠিক প্রমাণ ছাড়া মেয়েদের লেখা প্রকাশ করত না।

    পত্রিকাটি ভাগ, খণ্ড ও কল্প নামক বিভাগে প্রকাশিত হত। প্রথম সম্পাদক উমেশচন্দ্র দত্তর সম্পাদনা কালে ব্রাহ্মসমাজে নানা কারণে তীব্র অন্তর্দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। সেটি চরম আকার ধারণ করে কেশবচন্দ্র সেনের নাবালক জ্যেষ্ঠা কন্যা সুনীতি দেবীর সঙ্গে কোচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ ভূপ বাহাদুরের বিবাহকে কেন্দ্র করে। এর ফলে ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ দু ভাগে ভাগ হয়ে যায়। কেশব অনুগামী উমেশচন্দ্র কোন পক্ষ অবলম্বন করবেন এই নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। পরে কেশবের বিরুদ্ধপন্থী সাধারণ ব্রাহ্মসমাজে যোগদান করেন এবং এক বছর বন্ধ থাকার পর ১২৮৬ বঙ্গাব্দের কার্ত্তিক মাস থেকে পত্রিকাটি সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশিত হতে থাকে। প্রথমে পত্রিকায় কেশচন্দ্রেরই মতামত প্রকাশিত হত। তিনি ধর্মের সঙ্গে সম্পর্ক বিহীন স্ত্রীশিক্ষার বিরোধী ছিলেন। কিছু কিছু বিষয়ে রক্ষণশীল মনোভাবেরও প্রকাশ ঘটেছে। পরবর্তীকালে সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের মতামতই পত্রিকায় প্রকাশিত হত।

    ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’র প্রথম সংখ্যাটি বেরিয়েছিল ১২৭০ বঙ্গাব্দের ভাদ্র মাসে। ১২৮৫-এর বৈশাখে ১৭৭তম সংখ্যা পর্যন্ত প্রকাশনার ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ ছিল। এর পর ১৭৮তম সংখ্যাটি বেরোয় ১২৮৬ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসে। মাঝে পত্রিকাটি বন্ধ ছিল। তখন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা একে অপরের সংবাদ পরিবেশনা, সমালোচনা ও অন্যান্য তথ্যাদি নিয়মিত প্রকাশ করত। পুনঃ প্রকাশিত হবার পর ১২৮৭-এর ৮ বৈশাখ (১৯ এপ্রিল, ১৮৮০) ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকায় নিম্নবর্ণিত বিজ্ঞাপনটি বেরিয়েছিল।

    “এদেশীয় স্ত্রীলোকদের হিতার্থ প্রথম প্রকাশিত এই পত্রিকাখানি প্রায় ১৬ বৎসর কাল চলিয়া মধ্যে বিশেষ দুর্ঘটনা প্রযুক্ত এক বৎসর বন্ধ ছিল। গত কার্ত্তিক মাস হইতে ইহা পুনঃ প্রকাশিত হইয়া ছয় মাস কাল নির্বিঘ্নে ও নিয়মিতরূপে চলিয়া আসিয়াছে।”

    ১৮৬৩ সালের অগাস্ট সংখ্যার সম্পাদকীয়

    পুরোহিত সমাজ যেমন ধর্মের মূলতত্ত্বকে আড়াল করে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে নানা আচার অনুষ্ঠান ও কুসংস্কার চাপিয়ে দিয়ে সরল বিশ্বাসী সাধারণ মানুষকে যুগের পর যুগ ধরে বিভ্রান্ত করেছে; সমাজের নীতিনির্ধারকরাও তেমনি সমাজ অধঃপতনে যাবার দোহাই দিয়ে স্ত্রীশিক্ষা ও স্বাধীনতার বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেছে নিজেদের ভোগ বিলাসের রাস্তা প্রশস্ত করতে। ইংরেজ শাসকদের আমরা যতই দোষ দিই, ইংরাজি শিক্ষা শিক্ষিত একদল যুক্তিবাদী মন ও উদার হৃদয়ের যুবকরাই স্ত্রীশিক্ষার অনুকূলে মত প্রকাশ করেছে এবং এটিকে কর্যকরী করতে নানা পত্র-পত্রিকা প্রকাশ করে জনমত গড়ে তুলেছেন। একই উদ্দেশ্যে প্রকাশিত ‘মাসিক পত্রিকা’র কিছু পরেই ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’র আত্মপ্রকাশ ঘটে। ইংরাজ শাকেরা অবশ্যই এই প্রচেষ্টাকে সমর্থন করেছেন। বেথুন সাহেব (John Elliot Drinkwater Bethun) এগিয়ে এসে ১৮৪৯ সালের ৭ মে প্রতিষ্ঠা করেছেন বেথুন স্কুল (বীটন স্কুল বলে পরিচিত ছিল)। ২১ জন মেয়েকে নিয়ে যাত্রা শুরু। ১৮৭৯ সালে এটিই হিন্দু-মহিলা-বিদ্যালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে বেথুন কলেজে পরিণত হয়। ভারতবর্ষের প্রথম মহিলা কলেজ এভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয়।

    দীর্ঘ ৪৪ বছর উমেশচন্দ্রের সম্পাদনায় ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর মৃত্যু হয় ১৩১৪ বঙ্গাব্দের ৪ আষাঢ়। এরপরে বিভিন্ন সময়ে সম্পাদনা ও পরিচালন ব্যবস্থায় ছিলেন সুকুমার দত্ত, তারাকুমার কবিরত্ন, সূর্য্যকুমার চট্টোপাধ্যায়, ক্ষেত্রগোপাল মুখোপাধ্যায় প্রমুখ ব্যক্তিরা। শেষ সম্পাদক ছিলেন আনন্দকুমার দত্ত। তাঁর সময়ে পত্রিকাটির জনপ্রিয়তা হ্রাস পায় এবং ১২শ কল্প ৩য় ভাগ (বৈশাখ - চৈত্র ১৩২৯) প্রকাশিত হবার পর এটি বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘ প্রায় ৬০ বছর ধরে পত্রিকাটি প্রচারিত হয়েছে। প্রকাশনার পেছনে একটি প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ ছিল বলেই হয়তো পত্রিকাটি অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও দীর্ঘদিন সচল ছিল। ব্যক্তি উদ্যোগে প্রকাশিত হলে অনেক পত্রিকার মতো এটিও অনেক আগেই বন্ধ হয়ে যেত।

    তথ্যঋণ : অবসর ডট নেট

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @