বহুরূপীর অন্দর-কথা

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের প্রথম পর্বে শ্রীনাথ (ছিনাথ) বহুরূপীর কথা মনে আছে? পরিচিত এক দৃশ্য- “বেশ করিয়া দেখিয়া ইন্দ্র কহিল, দ্বারিকবাবু এ বাঘ নয় বোধহয়। তাহার কথাটা শেষ হইতে না হইতে সেই রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার দুই হাত জোর করিয়া মানুষের গলায় কাঁদিয়া উঠিল, পরিষ্কার বাংলা করিয়া কহিল, না বাবুমশায় না, আমি বাঘ ভালুক নই। ছিনাথ বহুরূপী।”
বাংলা সাহিত্যের বাইরে বাংলা চলচ্চিত্রেও সত্যজিৎ বা ঋত্বিকের ফ্রেমে বহুরূপী অন্য মাত্রা পেয়েছে। সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘কাপুরুষ মহাপুরুষ’-এ রবি ঘোষের কালী সাজ প্রকট করে তোলে কুসংস্কারের ভণ্ডতাকে। ঋত্বিক ঘটক তাঁর ‘সুবর্ণরেখা’ ছবিতে দেশভাগ এবং উদ্বাস্তু সমস্যার ছবি প্রকট করে তুলেছেন এক বহুরূপী চরিত্রের মাধ্যমে। কালী সাজে সেই বহুরূপী ছোট্ট সীতার কাছে আসে। সীতা প্রবল ভয় পায়। কখনও শিব, কখনও কালী অথবা পৌরাণিক নানা চরিত্র- মুখে রং মেখে নিজেদের ফুটিয়ে তোলেন তাঁরা। থিয়েটার বা যাত্রাপালার মঞ্চ নয়, মেঠো পথ, গৃহস্থের বাড়ি এগুলোই তাঁদের অভিনয়ের পোডিয়াম। সামান্য কিছু পারিশ্রমিক মেলে, সঙ্গে মুঠো চাল, আলু, কখনও তাও নয়। এই বহুরূপী শুধুমাত্র গ্রামবাংলার নয়, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের এক প্রচলিত লোকশিল্প। এরফলে একসময় বহু মানুষ জীবিকা নির্বাহ করতেন। সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বহুরূপীর সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। বর্তমান প্রজন্মকে মাথায় রেখে তাঁদের রুচির সঙ্গে হয়তো আপস করতে হয়েছে। তবুও এই লোকশিল্প মরে যায়নি। যেমন হুগলি জেলার জ্যোৎসাম্ভু গ্রামে শ্রী কালিপদ পাল, বংশ পরম্পরায় এই বহুরূপী ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। তাঁর রং তুলি পরচুল পোশাকের ভালোবাসা এখনও ফুরোয়নি। আজকের ছবিমহল উৎসর্গ করা হল মহান শিল্পী শ্রী কালিপদ পালকে। বাংলার বহুরূপী শিল্পকে নানা আঙ্গিকে তুলে ধরেছেন আলোকচিত্রী বিজয় চৌধুরী। আসুন, গ্যালারি ঘুরে বহুরূপীদের চিনি...
“নতুন ও অন্য ব্যবহারে/ ভরা চুলে করবীর মতো/ দেখা হবে।”
“এমন ভাবে সিঁদুর রাখছে কপালে/ যে বুঝতে পারবে না/ কেউ কিছুই বুঝতে পারবে না।/ এমনকি বুঝতে পারবে না/ আমাদের আর স্থায়ী চাকরি নেই।”
“দু’একটা অদ্ভুত রাস্তা থাকে/ দু’একটা ফাঁকা বহির্ভূত রাস্তা/ দু’একজন ধু ধু করা লোক থাকে সেই রাস্তায়/ যারা ফেরে না, ফোকরে তাকায় না”
“একটা কি চাঁদ উঠেছে না বৃষ্টিতে ভিজেছে অর্জুন গাছ/ সেই অর্জুন গাছে বসেছে পায়রা”
“পায়রা পিছলে যাবে/ এমনি হ’য়েছে আকাশ/ রোদ এমন যে কাগজে ছাপানো যায়।”
“আমাকে একটা কাজ দাও, যে কোন, যেমন তেমন একটা কাজ/ মাইরি-মেরী করে বলছি/ একটা কাজ দাও/ এই নিত্যিদিনের বানভাসি আর ভাল লাগছেনা।”
“পয়সা না, আজ ঢেলে ছড়াবে হাসি/ সদাবাহার এসে উঠবে কোথাও/ যোগ হচ্ছে মানে অনেক মিলে যাচ্ছে/ ঘটে যাচ্ছে সকালবেলার মিলনসার।”
“যারা যারা চুপ করে আলো দিয়ে যায় ময়দানবের মতো”
ছবি- বিজয় চৌধুরী
ঋণ- স্বদেশ সেন