হাট বসেছে রবিবারে, বাগবাজারে গঙ্গাপারে

স্থান সঙ্কুলানের অভাবে হাতিবাগানের সেই বিখ্যাত ‘পাখির হাট’ একসময় উঠে এসেছিলো বাগবাজার সংলগ্ন গ্যালিফ স্ট্রিটে। সে প্রায় আজ থেকে কুড়ি-বাইশ বছর আগের কথা। জায়গা বদলেছে, বদলেছেন মানুষজনও, কিন্তু ‘পাখির হাট’ তার ভোল বদলে ফেলেনি। আজও একইরকম ঐতিহ্য বহন করে এগিয়ে চলেছে বেচাকেনা, দরদাম, কখনো জমাটি আড্ডা, আবার কখনো বা চিরকালীন বন্ধুত্ব।
টালা পোস্ট অফিস থেকে বাগবাজার বাটার দিকে এগোলে রাস্তার ডানদিকে ট্রামলাইন বরাবর বসে এই হাট। সপ্তাহান্তে ছুটির দিনে অর্থাৎ রবিবার হঠাৎ করে এই হাট অজানা মানুষের নজরে এলে কলকাতার দুর্গাপুজোর দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠাও অসম্ভব নয়। বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বললে জানা যায়, তাঁরা মোটামুটি শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা সকাল ছ’টার আগেই তাঁদের পসড়া সাজিয়ে বসে পড়েন। হাট চলে প্রায় বারো ঘণ্টা। বি.টি. রোড থেকে গ্যালিফ স্ট্রিটে ঢুকলে প্রথমেই নজরে আসে অসংখ্য রঙিন পাখির সম্ভার। দেশি-বিদেশি, চেনা-অচেনা পাখির কিচিরমিচির কানে আসে। খাঁচায় বন্দি করে তাদের দূর-দুরান্ত থেকে বিক্রেতারা নিয়ে আসেন কিছু লাভের আশায়। স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে শিল্প-সাহিত্যে যাদের আসন চিরস্থায়ী, তাদের খাঁচায় বন্দি দেখলে কষ্টও হয় বৈকি! নানা জাতের বদ্রী, কতরকমের টিয়া, কতশত পায়রা ইত্যাদি সকলকে ছাড়িয়ে এগোলে নজরে আসবে বিভিন্ন জাতের বিদেশি কুকুর। হাটের এই জায়গাটিতেই যে সবচেয়ে বেশি ভিড় থাকে সে কথা বলাই বাহুল্য। কে না জানে কুকুর মানুষের প্রিয় বন্ধু? এখান থেকে মানুষ তাই বিপুল অর্থ খরচ করে ছোটো ছোটো কুকুরছানা বাড়ি নিয়ে যান। পরম যত্নে সন্তানস্নেহে বড়ো করেন।
এরপরই দেখা যায় বিভিন্ন ছোটো প্রাণী যেমন খরগোশ, গিনিপিগ, হ্যামস্টার, সাদা ইঁদুর নিয়ে বসেছেন কিছু মানুষ। বিক্রিবাটাও ভালো থাকে এইসব জায়গায়। লোহার খাঁচা, মাছের ট্যাঙ্ক, অ্যাকোরিয়ামের গাছ-সরঞ্জাম-সামগ্রী, হাঁস-মুরগির ছানা এইসব ছাড়িয়ে আমরা এবার এসে পড়ব মাছের জায়গায়। অসংখ্য প্রজাতির নাম-না-জানা মাছের সম্ভার এখানে। রাস্তার দু’ধারে সজ্জিত ট্যাঙ্কগুলিতে ছোটো-বড়ো-মাঝারি মাছের ওঠানামা দেখলে মনে হয় যেন জলে রঙের খেলা চলছে। বিভিন্ন রকমের ফাইটার-গোল্ডফিশ-অস্কার-ফ্লাওয়ার হর্ণ ইত্যাদি সমস্ত মাছের স্টলগুলিতে ভিড় জমিয়ে রাখেন ক্রেতারা। বিক্রেতারাও খুব যত্নসহকারে মাছের পরিচর্যার ব্যাপারে তাঁদের বুঝিয়ে দেন। মাছ শেষ হলে শুরু হয় গাছের আহ্বান। পৃথিবীর মাটি থেকে হারাতে বসেছে সবুজ। কিন্তু এখানে এলেই বোঝা যায় খোদ কল্লোলিনী মহানগরীর বুকেও গাছপ্রেমী মানুষের সংখ্যা নেহাৎ কম নয়। নানাপ্রকার সুগন্ধি-গন্ধহীন ফুলগাছ থেকে শুরু করে সবজি বা ফলের গাছ, অর্কিড থেকে শুরু করে ক্যাকটাস-সাকুল্যান্ট, বনসাই থেকে শুরু করে ইন্ডোর প্ল্যান্ট সমস্তরকম গাছের দেখা মেলে এই চত্বরে।
আরও পড়ুন
এক যে আছে হাওড়া ব্রিজ
আট থেকে আশি সমস্ত প্রজন্মের মানুষ এখানে এসে ভিড় জমান, একসাথে আড্ডা মারেন। অনভিজ্ঞ বা স্বল্প অভিজ্ঞকে হাতে ধরে শিখিয়ে-বুঝিয়ে দেন অভিজ্ঞ গাছপালক। অসমবয়সীদের মধ্যেও নজিরবিহীন বন্ধুত্ব, সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। চলতে থাকে লেনদেন, ব্যবসাও। হাটের এই অংশেই পাওয়া যায় বিভিন্ন ধরনের গাছের জন্য প্রয়োজনীয় মাটি, সার, রকমারি টব, রাসায়নিক ইত্যাদি সমস্ত কিছুই। চলতে চলতে মানুষজন অপেক্ষমান ভ্যান থেকে ফল কেনেন, ডাবের জলে গলা ভিজিয়ে নেন কিংবা খাবারের গুমটিতে দাঁড়িয়ে খিদে মেটান।
বাগবাজারের ‘পাখির হাট’ বা গ্যালিফ স্ট্রিট পেট মার্কেট আয়তনে পিছনে ফেলে দেয় পূর্ব মুম্বাইয়ের কুরলা ফিশ মার্কেট বা হায়দ্রাবাদের উইকলি পেট মার্কেটকেও। রবিবারের এই হাটে ব্যবসায়ীরা বৈধ লাইসেন্স সহকারেই ব্যবসা করেন ও অর্থ উপার্জন করেন। একই সঙ্গে ক্রেতা-বিক্রেতা-চিত্রগ্রাহক বা কেবলই দর্শনার্থী বহু মানুষের মিলনক্ষেত্র এবং প্রকৃতির মূল্যবান প্রাণ ও উদ্ভিদে পরিপূর্ণ এই হাট বহন করে খাস কলকাতার গৌরবকেও।