অতসী — ‘উন্মাদ’কালের জীবনযুদ্ধে জয়ী হবার একটি সফল চিত্রায়ণ

অতসী কর্মকার — আমাদের আশেপাশের গলিঘুঁজিতে, গ্রাম-শহর-বন্দরে কিংবা বাড়ির পাশেই সে থাকে। অতসী স্বপ্ন দ্যাখে। সমস্ত অত্যাচার সহ্য করেও সে পরিবারকে ভালোবাসতে চায়। কারণ তার একটা হৃদয় আছে, হৃদয়ের যন্ত্রণা আছে। যে যন্ত্রণা খুঁড়ে সে দেখে নিতে চায় তার নিজের বাঁচার পৃথিবী। কিন্তু "কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে"!
অতসীর মা এবং দাদা (তথ্যচিত্র থেকে)
পুতুল মাহমুদ পরিচালিত এবং রত্নাবলী রায় প্রযোজিত একটি ৫২ মিনিটের তথ্যচিত্র 'অতসী'। একটি মেয়ের ট্র্যাাজেডি নয়, জীবনযুদ্ধে জয়ী হবার গল্প বলে এই ছবি। দরিদ্র পরিবারের প্রতিটি অস্বাভাবিক সদস্যের মুখোমুখি হয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিটি মন্তাজ এবং প্রত্যেকটি ফ্রেমের অভিব্যক্তি সার্থক হয়ে ওঠে অতসীর জীবনের নানা পথের বাঁকে।
অতসী একটি দরিদ্র পরিবারের মেয়ে। বাবার মৃত্যুর পর পরিবার তাঁকে 'পাগল' ভাবতে থাকে। দিনের পর দিন তাঁকে মানসিক ও শারীরিকভাবে অত্যাচার করতে থাকে। অতসীর কথায়, "আমি তো শুধু দু-মুঠো খেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মা আর দাদা আমায় পাগল বানিয়ে দিতে চেয়েছিল।" শেষমেশ অতসীকে জোর করে ভর্তি করানো কয় কলকাতার একটি সরকারি মানসিক হাসপাতালে (কলকাতা পাভলভ হাসপাতাল)। সেখানে দুই বছর কাটিয়ে দেন অতসী। বাড়ি ফিরে আসার পর সেখানকার পরিবেশ আরও প্রতিকূল হতে থাকে। অতসী ক্রমশ একা হয়ে যান। এই নিঃসঙ্গ জীবনে যখন অত্যাচার সহ্য করা ছাড়া আর কিছুই নেই, সে সময় নিছক সময় কাটানোর তাগিদেই ফেসবুকে একটি অ্যাকাউন্ট খোলেন। কিছুদিনের মধ্যেই স্ক্রল করতে করতে জমে যায় অনেক বন্ধুত্বের বার্তা। বার্তা পাঠাতে থাকেন অতসীও। তারপর একদিন হঠাৎ করেই পরিচয় হয়ে গেল এক পাঞ্জাবি ছেলের সঙ্গে, সন্দেশকুমার নাঙ্গলো। যিনি কর্মসূত্রে থাকেন সৌদি আরবে।
অতসী এবং সন্দেশকুমার
তারপর? একে অপরের প্রতি বিশ্বাস জন্মাল। কাঁদার কোল পেলেন অতসী। ভার্চুয়াল আলাপ প্রেমের পরিণতি পেল। ওরা বিয়ে করলেন। ওরা বাঁচলেন বাঁচার মতো করে। অতসীর জীবনে শুরু হল এক নতুন অধ্যায়। অতসীর স্বামী বিয়ের আগে বলেছিলেন, "আমার সঙ্গে থাকলে ভালো থাকবে"। ক্রমশ ভেঙে পড়া একলা হয়ে যাওয়া অতসীর মুখে ফুটে উঠল টুকরো হাসি। বিয়ের পর অতসীর স্বামী বললেন, "দুঃখ কোরো না। অতীতে বেঁচো না। আমার সঙ্গে স্বপ্ন দ্যাখো। তোমার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবো।"
নোনাধরা দেওয়াল। চিলেকোঠা। এ ছবির প্রত্যেকটি ফ্রেম হয়ে ওঠে রঙীন। কখনও জিনস-টপ, কখনও চুড়িদারে সিঁদুর আর হাতের চুড়ির গোছায় হাসির রেখা। পরিচালক পুতুল মাহমুদ কী সুন্দর এই ফ্রেমগুলি ধরেছেন। স্বামী সন্দেশকুমারের একটি কথা বারবার মনে পড়ছে। ফ্রেমে আলাদা আলাদাভাবে দেখা যাচ্ছে অতসী আর সন্দেশকে। সন্দেশ মাঝে মাঝে অতসীর দিকে তাকাচ্ছেন। লাজুক হাসি হাসছেন। আর বলছেন, ‘‘কলকাতায় আসার আগেই অতসীর প্রতি আমার পুরো বিশ্বাস চলে এসেছিল। তখনই বিয়ে করব ঠিক করি।’’
অঞ্জলিতে 'অতসী'র শুটিংয়ের সময় পরিচালক পুতুল মাহমুদ
নিজের বাড়িতে মা-দাদার কাছে তেমন ভালোবাসা পাননি অতসী, কিন্তু শ্বশুরবাড়ির আদরের বৌমা হয়ে গেছেন। ছেলের বাড়িই বাঙালি বৌমার বিয়ের দায়িত্ব নেয়। অতসীর কলকাতার বাড়িটিও মানসিক হাসপাতালের মতোই অপরিচ্ছন্ন, জীর্ণ। এই তথ্যচিত্রে অতসীর ভেঙে পড়ার এবং নিঃসঙ্গ থাকার কোনো গল্পই দেখানো হয়নি। জীবনযুদ্ধে জয়ী হবার পর তিনি যখন সবটা একটু একটু করে গোছাতে চাইছেন, মা আর দাদার ভালোবাসা আবার ফিরে পেতে চাইছেন, এখানে সেইসব দৃশ্য দেখানো হয়েছে অত্যন্ত নিঁখুতভাবে। জীবনকে তিনি সেলিব্রেট করছেন, এই ছবিও তাই সেলিব্রেশনের। আশাবাদের। আত্মবিশ্বাসের।
তথ্যচিত্রের এক জায়গায় নিজের কথা বলতে গিয়ে আত্মবিশ্বাসী অতসী বলেন, ‘‘মানসিক হাসপাতালটাকে অনেকেই মানুষ ছুড়ে ফেলার ধাপার মাঠ ভাবেন। আর খোঁজও নেন না। সুযোগ পেলে অনেকেই কিন্তু নতুন জীবন পেতে পারেন।’’ সমাজকর্মী রত্নাবলী রায় তাঁকে এবং এরকম অসংখ্য মানুষদের সেই ভরসার কথাই ঢুকিয়ে দিচ্ছেন এখনও তাঁর 'অঞ্জলী' (মেন্টাল হেলথ রাইটস অর্গানাইজেশন)-র মাধ্যমে।
সম্পূর্ণ তথ্যচিত্র। এটি মাত্র এক সপ্তাহ দেখতে পাবেন শুধুমাত্র বঙ্গদর্শনে
এই ছবির নির্মাতা পুতুল মাহমুদ একজন শিক্ষক এবং একইসঙ্গে পরিচালক ও প্রযোজক। কয়েকবছর আগে 'কসমিক সেক্স' চলচ্চিত্রটি প্রযোজনা করেন তিনি। এছাড়াও বেশ কয়েকটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি এবং তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন। বর্তমানে তিনি কলকাতার সত্যজিৎ রায় ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইন্সটিটিউটে শিক্ষকতা করেন।
শ্রেষ্ঠ তথ্যচিত্র হিসেবে মুম্বাই আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ২০২০-তে পুরস্কৃত হয় 'অতসী'। ২০১৬ সাল থেকে পরিকল্পনা করা এই ছবির কাজ শেষ হয় ২০১৭ সালে। তথ্যচিত্রটি পৌঁছে যায় কেরালা আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য ও তথ্যচিত্র উৎসব, কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব এবং আরও অনেক জায়গায়।
অতসী তথ্যচিত্রের পোস্টার
এমনই কিছু মানুষকে, তাদের সঙ্গে মিশে বা না মিশে আমরা তাদের 'অপর' করে দিই। পরিচালক পুতুল মাহমুদ 'অপর' করে দেওয়া মানুষকে নিয়েই এই কাজ করতে চেয়েছেন। সেইসঙ্গে অতসীর অত্যাচারের কাহিনি না দেখিয়ে বলেছেন ভালোবাসার কথা। অতসীর দাদা-মার থেকে মানসিক যন্ত্রণা পেলেও তাঁরা মেয়েটির জন্য কাঁদে। যখন মেয়ে বাপেরবাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ি চলে যায়, মা তাঁকে জড়িয়ে ধরে কাঁদেন। ট্রেন ছেড়ে চলে যাওয়া অবধি চিৎকার করে মেয়েকে বলতে থাকেন, "আবার আসিস, আবার আসিস কিন্তু"। এই আর্তি সন্তানের প্রতি মায়ের। তাই শুধুমাত্র যন্ত্রণা বা নিঃসঙ্গতা নয়, ভালোবাসার সমস্ত উপকরণ রেখেছেন পরিচালক। 'অতসী' ছবিটি হয়ে উঠেছে 'উন্মাদকালের' ভালোবাসার ছবি। যা দৃশ্যত সুন্দর, অনির্বচনীয়।
অতসী (তথ্যচিত্র) | পরিচালক- পুতুল মাহমুদ | ভাবনা ও প্রযোজক- রত্নাবলী রায় | সম্পাদনা- অমিতাভ চক্রবর্তী | চিত্রগ্রহণ- সৌরভ কান্তি দত্ত | শব্দ- অর্কদীপ কর্মকার | লাইন প্রোডিউসার- দেবারতি দাস, তথাগত ভট্টাচার্য, Magic Lantern।