No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    শতবর্ষে বাংলা ছবির বিস্মৃত ‘মানিক’ – অসিত সেন

    শতবর্ষে বাংলা ছবির বিস্মৃত ‘মানিক’ – অসিত সেন

    Story image

    ৯২২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর তাঁর জন্ম। সেই হিসেবে ২০২২ সাল প্রখ্যাত ভারতীয় চলচ্চিত্র-নির্মাতা অসিত সেন-এর জন্ম শতবর্ষ। অজয় কর, পিনাকী মুখার্জি, নীরেন লাহিড়ী, অগ্রদূত প্রমুখদের মতো অসিত সেনও বাংলা চলচ্চিত্রের সেইসব প্রতিভাবান নির্মাতাদের মধ্যে পড়েন যিনি ‘সত্যজিৎ-মৃণাল-ঋত্বিক’ ত্রয়ীর ব্যাপক খ্যাতি ও জনপ্রিয়তার আড়ালে ঢেকে গিয়েছেন। কিন্তু, ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যাবে, অসিত সেন বাংলা এবং হিন্দি ছবির জগতে তাঁর গভীর ছাপ রেখে গেছেন। ‘বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগ’-এ তাঁর চলচ্চিত্রের স্তম্ভ হয়ে উঠেছিল শক্তিশালী চিত্রনাট্য, নারী চরিত্রের শক্তিশালী চিত্রায়ন, উজ্জ্বল অভিনয় এবং অবশ্যই, গান।

    সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর কর্মজীবন এবং পরিচালিত ছবিগুলি নিতান্তই সাদামাটা মানের ছিল। কিন্তু, যেসময় ‘মূলধারা’ এবং ‘সমান্তরাল’ সিনেমা বলে ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতে কোনও ভেদাভেদ ছিল না, সেই সময় তাঁর সিনেমা নিজস্ব ভাষা তৈরি করতে পেরেছিল। 

    ১৯২২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর আধুনিক বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন অসিত সেন। ‘পূর্বরাগ’ (১৯৪৭) ছবিতে তাঁর কাকা, তৎকালীন প্রখ্যাত ক্যামেরাম্যান রামানন্দ সেনগুপ্তকে অ্যাসিস্ট করার আগে, ফটোগ্রাফির প্রতি প্রবল আগ্রহের জেরে তিনি ডি কে মেহতার ক্যামেরা সহকারী হিসেবে কাজের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে দুনিয়ায় প্রবেশ করেন। এরপর গান্ধিজির নোয়াখালি এবং পাটনা সফরকে কেন্দ্র করে ১৬ মিমি দৈর্ঘ্যের একটি স্বাধীন তথ্যচিত্রের শুটিং-এর জন্য এক মাসের জন্য গান্ধিজির দলে যোগ দেন।

    ১৯৪৮ সালে অসমিয়া ছবি ‘বিপ্লবী’র মাধ্যমে পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।  ছবিটি ছিল একজন তরুণ সংগ্রামীকে নিয়ে, যিনি দেশের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেন। সেসময় অনেক অসমিয়া ছবিতেই ঘনঘন তুলে ধরা হতো র‌্যাডিক্যাল আত্মবলিদান এবং জাতীয়তাবাদ, যা ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন বা আইপিটিএ-এর সদস্যদের উদ্বুদ্ধ করতো। সেদিক দিয়ে অসিতবাবুর ‘বিপ্লবী’ বহু বছর এই ধারার আদর্শ চলচ্চিত্র হিসেবে প্রাধান্য পেয়েছিল। শুধু তাই নয়, খুবই অপ্রত্যাশিত ভাবে এই সিনেমা থেকে তাঁর নাম মুছে ফেলা হয়েছিল ছবির প্রযোজকের সঙ্গে গোলমাল বাঁধার কারণে।আলফ্রেড হিচকক এবং ড্যানি কায়ের কাজ থেকে অনুপ্রাণিত হতেন তিনি। অরুন্ধতী দেবী অভিনীত তাঁর নির্মিত প্রথম বাংলা ছবি ‘চলাচল’ (১৯৫৬) বক্স অফিসে ব্যাপক সাড়া ফেলে। পরিচালক-অভিনেত্রীর রসায়ন তাঁর পরবর্তী ছবি ‘পঞ্চতপা’ (১৯৫৭)-তেও কাজ করেছিল। সুচিত্রা সেন অভিনীত ‘দীপ জ্বেলে যাই’ (১৯৫৯) এবং ‘উত্তর ফাল্গুনী’ (১৯৬৩), বাংলা ছবির এই দুই মাইলফলকের সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছেন তিনি।  উত্তর ফাল্গুনীর হিন্দি রিমেক ‘মমতা’ (১৯৬৬) অসিত সেন এবং সুচিত্রা সেনের হিন্দি সিনেমার কেরিয়ারে সবচেয়ে বড়ো বাণিজ্যিক হিট ছবি।

    তিনি প্রায় ২০টি হিন্দি এবং বাংলা ছবি পরিচালনা করেছিলেন। সেগুলির মধ্যে কিছু ছবি বক্স-অফিসে হিট হয়েছিল, আবার কিছু ছবি কোনও ছাপ ফেলতে পারেনি। তবে, যেগুলি ছাপ ফেলেছিল সেগুলির মধ্যে, দীপ জ্বেলে যাই, উত্তর ফাল্গুনী, পঞ্চতপা, চলাচল, মমতা, আনোখি রাত (১৯৬৮), সফর (১৯৭০), অন্নদাতা (১৯৭২) -এর মতো ছবিগুলি ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে আছে।ছবির গল্প বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কোনও প্রদত্ত ধারা অনুসরণ করেননি তিনি। তাঁর সিনেমার উল্লেখযোগ্য দিকগুলি হলো- ক) সিনেমার বিষয়গুলি বেশিরভাগই প্রচলিত সাহিত্য থেকে নেওয়া খ) সিনেমাটোগ্রাফির উপর দক্ষতা তাঁকে সিকোয়েন্স ফ্রেম করতে, আলো পরিচালনা করতে এবং দৃশ্যগুলি অর্কেস্ট্রেট করতে ব্যাপকভাবে সাহায্য করেছিল গ) অভিনেতাদের থেকে নিঁখুত অভিনয় বের করে আনার ক্ষমতা ছিল তাঁর ঘ) প্রোটাগনিস্ট হিসেবে তাঁর ছবিতে প্রাধান্য পেত নায়িকারা ঙ) ভালো গান এবং দৃশ্যায়ন তাঁর ছবির বিশেষ সম্পদ।

    তিনি ‘Low-key’ শৈলী পছন্দ করতেন, অহেতুক গ্ল্যামারের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রবণতা ছিল না মোটেই। কিন্তু, হিন্দি কমার্শিয়াল সিনেমার চাহিদার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য ‘মমতা’য় একটু লাউড হতে হয়েছিল তাঁকে, ছবির মিউজিককেও হিন্দি সিনেমার চাহিদার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয়েছিল। তিনি কখনই চটকদার পরিচালক ছিলেন না এবং বেশিরভাগ ছবিতেই তিনি বর্ণনামূলক সেতু হিসাবে প্যানিং শট এবং ল্যাপ ডিসলসভের ব্যাপক ব্যবহার করতেন। ‘মমতা’ এবং ‘উত্তর ফাল্গুনী’তে মেয়েটির বেড়ে ওঠার ধারাবাহিকতায় তা বিশেষ করে লক্ষ্য করা যায়।অতীতের পথ ধরে হাঁটাহাঁটি করলে দেখা যাবে, সুচিত্রা সেনের পুরো কেরিয়ারে তিনটি সেরা অভিনয় ছিল অসিত সেন পরিচালিত ছবিতেই এবং এই তিনটি ছবির কোনোটিতেই উত্তম কুমার ছিলেন না। একটি হল দীপ জ্বেলে যাই, এবং আর দুটি একই ছবির দুটি ভাষার সংস্করণ, বাংলায় ‘উত্তর ফাল্গুনী’ এবং হিন্দিতে ‘মমতা’। সে যাই হোক, দীপ জ্বেলে যাই-এর হিন্দি সংস্করণ খামোশি (১৯৭০) ছবির জন্য ওয়াহিদা রেহমানকে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন অসিত সেন, সম্ভবত প্রযোজক হেমন্ত কুমার এটাই চেয়েছিলেন। কিন্তু ওয়াহিদা সুচিত্রার চেয়ে অনেক ভালো অভিনেত্রী হয়েও, সেই দৃশ্যগুলি পুনরুত্পাদন করতে পারেননি যেখানে আমরা নার্সকে হাসতে হাসতে পাগল হয়ে যেতে দেখি। ডাবিং ছাড়াই সুচিত্রার হাসি ছিল স্বাভাবিক, অন্যদিকে ওয়াহিদা যেভাবে হেসেছিলেন, তার ডাবিং প্রয়োজন ছিল। গুলজারের সুন্দর গান এবং অবিশ্বাস্যভাবে সুন্দর লিরিক্স ছাড়াও বাংলা অরিজিনাল গানটি হিন্দি রিমেকের চেয়ে অনেক ভালো ছিল।শর্মিলা ঠাকুর সম্ভবত একমত হবেন যে হিন্দি সিনেমায় তার কেরিয়ারে সবচেয়ে অসামান্য মর্মস্পর্শী অভিনয়ের মধ্যে একটি ছিল ডাঃ নীলার চরিত্র, রাজেশ খান্না এবং ফিরোজ খানের বিপরীতে ‘চলাচল’-এর হিন্দি রিমেক 'সফর'। যদিও, পশ্চাদপটে, কোনটিই ঐতিহাসিক শ্রেষ্ঠত্বের জন্য পরিচিতি পায়নি।

    ‘আনোখি রাত’ ছবিটির মাধ্যমে হিন্দি ছবি পরিচালনায় আত্মপ্রকাশ করেছিলেন অসিত সেন। দ্বৈত ভূমিকায় অরুণা ইরানি এবং জাহেদার চরিত্রে অভিনয়গুলি ছোট হলেও বেশ শক্তিশালী ছিল। সঞ্জীব কুমারও ছবিতে একটি অসাধারন চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। বলা হয়, এটিই প্রথম ভারতীয় সিনেমা যেখানে দু’জন সঙ্গীত পরিচালক কাজ করেছিলেন - গানগুলি লিখেছিলেন রোশান এবং ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর তৈরি করেছিলেন সলিল চৌধুরী। ‘আনোখি রাত’-এও অসিত সেনের প্রতিভা স্পষ্ট হয়েছিল, কারণ এটি কোনও বাংলা সিনেমার রিমেক ছিল না।

    ‘অন্নদাতা’র জুটি হিসেবে বেছে ছিলেন অল্পবয়সী জয়া ভাদুড়ি এবং প্রবীণ ওম প্রকাশকে। অস্বাভাবিক জুটি হলেও ছবির গান এবং চিত্রনাট্য, দুইই ছিল শক্তিশালী। গল্পটি এরকম ছিল, একটি অল্প বয়স্ক, আত্মমর্যাদাশীল মেয়ে যে তার জীবনের যাবতীয় চাপের কাছে আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকার করে। সেই মেয়েটিরই অভিভাবকের ভূমিকায় চমকে দেওয়ার মতো অভিনয় করেছিলেন ওম প্রকাশ।

    তবে, অসিত সেনের পরিচালনায় ব্যর্থতাও এসেছিল, এর কারণ হিসেবে অনেক বড় বড় শিল্পীরা মনে করেছিলেন যে তিনি তার ‘ম্যাজিকাল টাচ’ হারিয়েছেন। তাঁর অসফল চলচ্চিত্রগুলির মধ্যে রয়েছে – ‘আনোখা দান’ (১৯৭২), একই বছরে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘অন্নদাতা’। ‘মা অউর মমতা’ (১৯৭০) ছবিটিও ফ্লপ হয়েছিল, কিন্তু অল্প বয়সী ধর্মেন্দ্র এবং হেমা মালিনী জুটি হিট হয়েছিল ‘শরাফত’ (১৯৭০)-এ। এই দুটি ছবিতেই কেন্দ্রীয় চরিত্রে ছিল নারী। একটি ছিল অবিবাহিত মায়ের কষ্ট নিয়ে, আরেকটি ছিল তাওয়াইফকারী মহিলাদের জীবন সংগ্রাম নিয়ে। ‘মা অউর মমতায় নূতন এবং অশোক কুমারের কিছু দুর্দান্ত অভিনয় শৈলী দেখেছিল দর্শক, কিন্তু ছবিটি এখনও জনসাধারণের কাছে ভালোভাবে পৌঁছাতে পারেনি।

    তাঁর কম আলোচিত ছবিগুলির মধ্যে রয়েছে ‘জীবন তৃষ্ণা’ (১৯৫৭), যেটি দারুণ হিট করেছিল। প্রতিশোধের গল্প নির্ভর এই ছবিটি ছিল একেবারেই মূলধারার। তবে, উত্তম কুমার এবং সুচিত্রা সেন অভিনীত রোমান্টিক প্রধান চরিত্রের পরিবর্তে এই ছবিতে ছয়টি ভিন্ন চরিত্রের উপর ফোকাস করা হয়েছিল। এটি পরে অন্য একজন পরিচালক হিন্দিতে পুনর্নির্মাণ করেছিলেন এবং সেটিও বক্স অফিস হিট ছিল। রাজ কাপুর, শশী কাপুর এবং জিনাত অভিনীত ‘উকিল বাবু’ (১৯৮২) ফ্লপ করে। মেহেন্দি (১৯৮৩) ছবিটিও তাই হয়।১৯৭৬ সালে মুক্তি পায় দিলীপ কুমার ও সায়রা বানু ভভিনীত ‘বৈরাগ’, অসিতবাবুর ঘুরে দাঁড়ানোর যাবতীয় আশায় জল ঢেলে দিয়েছিল এই ছবিটাই। তাঁর শেষ সিনেমা ‘প্রতিজ্ঞা’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৮৫ সালে। ২০০১-এ তাঁর একমাত্র ছেলে পার্থকে রেখে হৃদ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি। জীবনের শেষ ১৬টা বছর সিনেমাজগত থেকেও ধীরে ধীরে অবলুপ্ত হয়ে গেছিলেন। তবে, সিনেমার ইতিহাসে স্বর্ণযুগ এবং অসিত সেনের ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করার জন্য তাঁর বেশ কিছু মূল্যবান সিনেমা তিনি রেখে গেছেন সিনেমাপ্রেমী, সিনেমা-গবেষক বা ছাত্রদের জন্য।

    প্রসঙ্গত, অসিত সেনের শতবর্ষ উদযাপন করছে ২৮ তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। প্রদর্শিত হচ্ছে তাঁর তিনটি ছবি—চলাচল, উত্তর ফাল্গুনী এবং দীপ জ্বেলে যাই। এছাড়া এবছর ‘সেন্টেনারি ট্রিবিউট’ বিভাগে থাকছে হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়, ভারতী দেবী, দিলীপ কুমার, কে আসিফ, আল্যাঁ রেনে আলি আকবর খাঁ, পাওলো পাসোলনির ছবি।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @