বাংলার ঐতিহ্য গালার পুতুলে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করছেন বৃন্দাবন চন্দ

শিল্প-সংস্কৃতির পীঠস্থান এই বঙ্গভূমি। শিল্প, সাহিত্য, গান, ছবি আঁকা, সবেতেই বাংলা পথ দেখিয়ে আসছে গোটা বিশ্বকে। এই সমস্ত কৃষ্টির মধ্যে অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যশালী হলো বাংলার স্থাপত্য এবং কুটিরশিল্প। শিল্পীদের নৈপুণ্যে শিল্পগুলি হয়ে ওঠে দৃষ্টিসুখ আর সৃষ্টিসুখের অনবদ্য মিশেল। এইসব শিল্পের মধ্যে আবার বাংলার পুতুলশিল্প আলাদা উল্লেখের দাবি রাখে। কাঠের, মাটির, কাপড়ের, পাটের, গালার- কতধরনের বৈচিত্র, কতরকমের রূপ! কিন্তু সময়ের আঘাতে তার অনেকগুলিই আজ বিলুপ্তির পথে, বিশেষ করে গালার পুতুল। শিল্পী বৃন্দাবন চন্দ (Brindaban Chanda) একার হাতে ধরে রেখেছেন বাংলার এই শিল্পকে।
গালার পুতুল (Shellac Dolls) নাম হলেও এই পুতুল বানাতে গালা ছাড়াও অন্যান্য জিনিসেরও দরকার পড়ে। অসীম ধৈর্য্য আর নিপুণ দক্ষতায় তৈরি হয় এই পুতুল। বৃন্দাবনবাবু জানালেন- “প্রথমে মাটি সংগ্রহ করতে হয় উঁইপোকার ঢিবি থেকে। তারপর সেই মাটিকে তিনদিন মতো জলে ভিজিয়ে রাখতে হয়। তাতে মাটি নরম হয়, আর মাটিতে থাকা বালি-কাঁকর আলাদা হয়ে যায়। তারপর হাতের চাপে সেই মাটি থেকে তৈরি করা হয় বিভিন্ন পুতুল। এরপর পুতুলগুলিকে প্রথমে ছায়াতে, তারপর রোদে শুকানো হয়। পুতুলগুলি সম্পূর্ণ শুকিয়ে গেলে সেগুলিকে ধাপে-ধাপে পোড়ানো হয় ঘুটের আগুনে।”
পোড়ানো হয়ে গেলে পুতুলগুলিকে রং করা হয় নানা ধরনের রং মাখানো গালা দিয়ে। পুতুলগুলির গায়ে নকশা করার জন্য তিনি ব্যবহার করেন গালার সুতো। গালা সংগ্রহ করা হয় লাক্ষা নামক একধরনের পোকা থেকে। পুতুলগুলি তৈরি করতে কোনওরকমের ছাঁচ ব্যবহার করা হয় না।
১৭৮৭ সাল থেকে এক তরুণ ব্রিটিশ ডেভিড এরিকসনের তত্ত্বাবধানে গালাশিল্প বাংলাতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিশ শতকের প্রথমদিক পর্যন্ত নুরিস নামের, বীরভূম নিবাসী একজাতির গালাশিল্পীরা এই কাজে অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে আয়োজিত করেছিলেন গালার পুতুলের ওয়ার্কশপ। তবে এই সময়ে তাঁদের সকলের উত্তরাধিকার একার কাঁধে বহন করছেন বৃন্দাবন চন্দ।
দ্য বেঙ্গল স্টোরের এক কর্মী বললেন- “গালার পুতুলে কোনওরকম রাসায়নিক ব্যবহার করা হয় না। তাই পুতুলগুলি পরিবেশবান্ধব। তাছাড়া হলদেটে-লাল রঙের মাটির পুতুলগুলির ওপর নানা রঙের নকশা ও কারুকাজ পুতুলগুলিকে আরও দৃষ্টিনন্দন করে তোলে।”
১৭৮৭ সাল থেকে এক তরুণ ব্রিটিশ ডেভিড এরিকসনের তত্ত্বাবধানে গালাশিল্প বাংলাতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিশ শতকের প্রথমদিক পর্যন্ত নুরিস নামের, বীরভূম নিবাসী একজাতির গালাশিল্পীরা এই কাজে অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে আয়োজিত করেছিলেন গালার পুতুলের ওয়ার্কশপ।
পূর্ব মেদিনীপুরের পটাশপুর-২ ব্লকের পশ্চিমসাই গ্রামের বাসিন্দা বৃন্দাবনবাবুদের বংশানুক্রমিক পেশা হলো শাঁখা তৈরি করা। একমাত্র বৃন্দাবনবাবুই গালার পুতুল (Lac Dolls) তৈরির সঙ্গে যুক্ত। তাঁর কথায় জানা গেলো যে, তাঁর সন্তানরাও গালার পুতুল তৈরি করার পেশায় আসতে আগ্রহী নয়। “এখানকার অনেকেই এই পুতুল তৈরি করতে জানে, কিন্তু কেউ তা পেশা হিসেবে বেছে নেয় নি” - বললেন তিনি।
ঊজ্জ্বল রঙের এই পুতুলের রকমফের অনেক- মানুষ, জন্তুজানোয়ার, দেবদেবী, বাদ নেই কিছুই। পুতুলগুলির বিস্তারিত কারুকাজ দেখলে মুগ্ধ হয়ে যেতে হয়। বৃন্দাবন চন্দ তাঁর বানানো গণেশের পুতুল উপহার দিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রীকেও, যা সেসময় মোদী গণেশ (Modi Ganesh) নামে বিখ্যাত হয়েছিলো।
কিন্তু আলোচনা ছাড়িয়ে শিল্পপ্রেমী মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে এই বাংলার গালাশিল্প, বাংলার গালার পুতুলকে নতুনভাবে বাঁচিয়ে তুলতে। কারণ শুধু এই শিল্পদ্রব্যগুলির নান্দনিকতাই নয়, আসলে বাংলার ঐতিহ্য গালার পুতুলশিল্পের (Bengal’s Traditional Shellac Doll) মধ্যে জড়িয়ে রয়েছে বঙ্গ সংস্কৃতির আত্মা।
গালার পুতুল অনলাইনে কিনতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।