‘আমার বাবার জীবনের সবচেয়ে বিপজ্জনক পর্বের সূচনা ছিল এই যাত্রা’

“সাবমেরিনটি যাত্রা শুরু করে কিল (Kiel, উত্তর জার্মানির শ্লেশউইগ-হোলস্টাইন প্রদেশের রাজধানী); নাবিকদের বলা হয়নি ওই দু’জন কোথায় যাচ্ছেন, তাঁরা শুধু জানতেন এই দুই মেশিনিস্টকে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার উত্তরে নিয়ে যেতে হবে। যাত্রার প্রাক্কালে সাবমেরিনে কিছু মালপত্র তোলা হল, আমার বাবা এবং তাঁর এডিসি আবিদ হাসান সাফরানিকে গোপনে নিয়ে আসা হল। আশঙ্কা ছিল, ব্রিটিশদের কাছে খবর পৌঁছে যাবে, সুদূর প্রাচ্যগামী একটি সাবমেরিনের একজন যাত্রীর নাম সুভাষচন্দ্র বসু।”
কথাগুলি বলছেন ডাঃ অনিতা বসু-পাফ, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এবং তাঁর অস্ট্রীয় স্ত্রী এমিলি শেঙ্কেল-এর কন্যা। নেতাজির যখন মৃত্যু হয়েছিল বলে মনে করা হয়, অনিতার বয়স তখন তিন। বাবাকে স্বচক্ষে কখনও দেখেননি তিনি। তাঁর স্মৃতিচারণের ভিত্তিতেই রচিত হয়েছে ‘দ্য অনিতা ডায়ালগস’ শীর্ষক ১২টি আলোচনা সমৃদ্ধ একটি সিরিজ, প্রযত্নে জার্মানিতে বসবাসকারী বঙ্গসন্তানদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সংস্থা ‘সম্প্রীতি’। এই সিরিজের মূল উদ্দেশ্য, নেতাজির ১২৫তম জন্মজয়ন্তীর যথাযথ উদযাপন।
ইতিহাস বলে, ১৯৪৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন তুঙ্গে, তখন একটি জার্মান ইউ-১৮০ ডুবোজাহাজ অর্থাৎ সাবমেরিনে চড়ে সুদূর প্রাচ্যের পথে পাড়ি দেন নেতাজি, সঙ্গে আবিদ হাসান। মূলত ব্রিটিশ এবং মার্কিন সাবমেরিন পরিবৃত অত্যন্ত বিপদসংকুল সমুদ্রপথ পার হয়ে ম্যাডাগাস্কারে তাঁদের তুলে দেওয়া হবে একটি জাপানি সাবমেরিনে, এমনটাই ছিল পরিকল্পনা। সিরিজের প্রথম পর্বে যেমনটা বলেছেন অনিতা, জার্মান সাবমেরিনের কর্মীরা জানতেন না তাঁদের দুই সহযাত্রীর প্রকৃত পরিচয়, অথবা তাঁদের প্রকৃত গন্তব্য।
জাপানের পথে, সাবমেরিন U-180 এর উপর সুভাষ বসু এবং ক্যাপ্টেন ওয়ার্নার মুসেনবার্গ
“ব্রিটেনের উত্তর উপকূল পেরিয়ে অ্যাটলান্টিক মহাসাগরে পৌঁছয় সাবমেরিন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পৃথিবীর যে সব সমুদ্রে সাবমেরিন যুদ্ধ হয়, সেগুলি এতই বিপজ্জনক ছিল যে অক্ষশক্তির তিন-চতুর্থাংশ নাবিক যুদ্ধে নিহত হন। আমার বাবা যে সাবমেরিনে যাত্রা করেছিলেন, সেটিও পরবর্তীকালে ডুবে যায়,” বলছেন অনিতা।
রোমাঞ্চকর এই যাত্রা সংক্রান্ত অধিকাংশ তথ্যই অনিতা সংগ্রহ করেন হেরমান উইন-এর কাছ থেকে, যিনি সেই ইউ-বোটের প্রধান মেশিনিস্ট ছিলেন, এবং সৌভাগ্যক্রমে যুদ্ধ থেকে প্রাণে বেঁচে ফেরেন। “আমার স্বামী (ডাঃ মার্টিন পাফ) এবং আমি যখন মিউনিখের কাছাকাছি আসি, তখন হেরমান অগসবার্গ শহরে থাকতেন। আমার কথা জানতে পেরে উনি নিজেই যোগাযোগ করেন, এবং সেই যাত্রার অনেক কাহিনি আমি ওঁর কাছেই শুনি,” বলছেন অনিতা। “আমার বাবার জীবনের সবচেয়ে বিপজ্জনক পর্বের সূচনা ছিল এই যাত্রা। আজকের যুগের অত্যাধুনিক সাবমেরিনেও খুব হাত পা ছড়িয়ে থাকা যায় না, আর সেসময়ের তো কথাই নেই। তার ওপর ছিল পৃথিবীর ভয়ঙ্করতম সমুদ্রপথ পার হওয়ার টেনশন, সর্বদা শত্রুর টর্পেডো বা বোমারু বিমানের আক্রমণের আশঙ্কা। খুবই বিপন্ন এক সময়।”
পরবর্তীকালে জার্মান ভাষায় এই যাত্রার একটি বিবরণ লিখেছিলেন উইন, যা পড়লে বোঝা যায়, দুই রহস্যময় সহযাত্রীকে নিয়ে কী ধন্দে পড়েছিলেন সাবমেরিনের কর্মীরা। “আমাদের মধ্যে জল্পনা হতো, এই দুই বিদেশী, হলদে-খয়েরি গায়ের রঙের ভদ্রলোক কারা? কালো কাপড়, কালো টুপি, এবং গোল গোল কালো চশমায় আরও রহস্যময় দেখাত দু’জনকে,” লিখেছেন উইন। তাঁর বর্ণনায় একজন “বেশ শক্তসমর্থ, আন্দাজ ১.৭০ মি লম্বা”, আর অন্যজন “ছোটখাটো, রোগা”।
সুরক্ষা বলয় পরিবৃত হয়ে ডেনমার্কের স্কাগেরাক দ্বীপসমূহ পেরিয়ে ক্রিস্টিয়ানসান্ড পৌঁছয় সাবমেরিন। কাউকে নামতে দেওয়া হয় না। কর্মীরা বুঝতেই পারেন, তাঁদের দুই রহস্যময় সহযাত্রীর খাতিরেই এই ব্যবস্থা। উইন লিখেছেন, “আমাদের জল্পনা ততদিনে এলোমেলো ডালপালা গজিয়েছে। একজন তো বলেই ফেলল: ‘ইনি হচ্ছেন ভারতের অ্যাডলফ, নিশ্চিত হিটলারের সঙ্গে ছিলেন। কিছুদিন আগেই একটা ম্যাগাজিনে দেখেছি’।” কিন্তু কম্যান্ডিং অফিসারের বক্তব্য ছিল, এই দু’জন হলেন বিশেষজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ার, যাঁদের নরওয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সাবমেরিনের বাঙ্কার তৈরি করতে।
তবে বার্গেন-এর কাছে এগেরনসুন্ড-এ সাবমেরিন পৌঁছনোর পর কর্মীদের শেষমেশ জানানো হয়, ওই দু’জন কারা এবং কোথায় যাচ্ছেন। “আমরা জানলাম, আমাদের সঙ্গে কিল থেকে জাহাজে উঠেছেন ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী সুভাষচন্দ্র বোস এবং তাঁর অ্যাডজুটান্ট আবিদ হাসান, আমাদের কাজ হলো তাঁদেরকে নিরাপদে ম্যাডাগাস্কারের কাছাকাছি সমুদ্র এলাকায় পৌঁছে দেওয়া, যেখান থেকে তাঁরা যাবেন হয় ভারত, না হয় বর্মায় জাপানি গুপ্ত বাহিনীর কাছে,” লিখেছেন উইন।
জাপানি সাবমেরিন I 29 এর নাবিকদলের সঙ্গে নেতাজি, সামনের সারির বাঁদিকের দ্বিতীয়জন, ২৮ এপ্রিল, ১৯৪৩
অনিতা যোগ করেন, “যুদ্ধের শেষে খুব অল্পসংখ্যক সাবমেরিন কর্মীই বেঁচে ছিলেন। আমরা যেসময় ১৯৭১ সালে জার্মানিতে থাকতে শুরু করি, তখন বাবার ইউ-বোটের প্রায় ৬০ জন নাবিকের মধ্যে জনা ১৫ জীবিত ছিলেন। অগসবার্গে একটি ডিনারে আমাদের আমন্ত্রণ জানান তাঁরা, আমার মা-ও উপস্থিত ছিলেন সেখানে।”
নেতাজির সেই সাবমেরিন যাত্রা শেষ হয় ১৯৪৩ সালের মে মাসে। কিন্তু তার রোমান্স আজও অমলিন।