No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    বেলঘরিয়ার প্রাচীন বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার

    বেলঘরিয়ার প্রাচীন বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার

    Story image

    বেলঘরিয়ায় এই বংশের প্রথম ব্যক্তিটির নাম ভুবনমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। কলকাতার সাহেবদের সঙ্গে পাটের ব্যবসায় প্রভূত অর্থ উপার্জন করেন তিনি। আদি বাসস্থান নিমতা থেকে উনিশ শতকের তৃতীয় ভাগে বেলঘরের দক্ষিণপাড়ায় এসে তিনি প্রাসাদোপম বাড়ি নির্মাণ করেন এবং আশেপাশের জমি কিনে ‘জমিদার’ হিসেবে অভিহিত হন। এখনও তাঁর সেই বাড়ির ভগ্নদশা দেখতে পাওয়া যায়, লুপ্তপ্রায় বংশের শেষ কয়েকজন যেখানে বসবাস করেন আজও।

    ডঃ গোপাল মুখোপাধ্যায় জানান, ভুবনমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় স্থানীয় গোয়ালা’দের থেকে দান গ্রহণ করেছিলেন বলে তাঁদের ‘গোয়ালা বামুন’ বলে অভিহিত করা হত এবং অঞ্চলের অন্যান্য ব্রাহ্মণ পরিবার তাঁদের সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক এড়িয়ে চলতেন। তবে এ নিয়ম বেশিদিন বলবৎ হয়নি সম্ভবত। কারণ বৈদ্যনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলে, বেলঘরের একমাত্র জগদ্ধাত্রী পূজা হত এঁদের ঠাকুরদালানেই এবং তাতে স্থানীয় বাসিন্দাদের যাতায়াতের সাক্ষ্যও পাওয়া যায়। 

    ভুবনমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুই সন্তান - নগেন্দ্রনাথ ও সুরেন্দ্রনাথ। ভুবনমোহনের মৃত্যুর পর সমস্ত সম্পত্তি দুই সন্তানের মধ্যে ভাগ হয়। নগেন্দ্রনাথ অপুত্রক হওয়ায় তাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যা নলিনী বিবাহের পরেও বাবার দেখাশোনা করার জন্য এই বাড়িতেই ফিরে আসেন এবং আমৃত্যু এখানেই বসবাস করেন। সাক্ষাৎ পেয়েছি নলিনীর পুত্র বিশ্বনাথ চক্রবর্তী’র স্ত্রী দুর্গা চক্রবর্তী’র, যাঁর বয়স বর্তমানে তিরাশি বছর। পরিবারটির সম্পর্কে যেটুকু তথ্য পাওয়া গেছে, প্রায় সবটাই তাঁর সৌজন্যে। তিনিই আমাদের জানিয়েছেন, নগেন্দ্রনাথ তাঁর স্বভাবদোষের ফলে অর্থাৎ বাঈজিবাড়ি গমন, মদ্যপান, রেস খেলা, জুয়া খেলা প্রভৃতির কারণে নিজের সম্পত্তির অনেকটাই উড়িয়ে দিয়েছিলেন। বরং সুরেন্দ্রনাথ(মৃত্যু পঁয়তাল্লিশ বছর বয়েসে, ১৯৩১ সালে) অনেকটাই বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন তাঁর আভিজাত্য। সুরেন্দ্রনাথের সন্তান বৈদ্যনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বেলঘরের একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি ছিলেন এবং কমিশনারও হয়েছিলেন একসময়। দুর্গা দেবী’র বিয়ের বছর দুয়েক পর অর্থাৎ ১৯৪৭-৪৮ সালে এ বাড়িতে একটি অনুষ্ঠানে প্রখ্যাত শিল্পী উদয়শঙ্কর নৃত্য পরিবেশন করেছিলেন। বিক্ষিপ্ত হলেও, বেলঘরিয়ার ইতিহাসের পক্ষে গৌরবময় তো বটেই!

    ভুবনমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ফিডার রোড থেকে বর্তমান প্রফুল্লনগর পর্যন্ত রাস্তাটি সম্পূর্ণ নিজের ব্যয়ে সংস্কার করান এবং সেটি তাঁর নামেই নামাঙ্কিত। তাঁদের শরিকি বাড়ি বহুবিভক্ত হয়ে বর্তমানে জর্জরিত। অনেক অংশ ভেঙেও ফেলা হয়েছে। শতাব্দীপ্রাচীন ঠাকুরদালানটি ভগ্নপ্রায় দশায় এখনও অবস্থিত। বেলঘরিয়ায় ইতিহাসের এমন জলজ্যান্ত নিদর্শন খুব বেশি নেই আর। কড়িবরগা ভেঙে পড়েছে, বেশিরভাগ অলঙ্করণ ধ্বংসপ্রাপ্ত, তবু তার মধ্যে থেকেও আমরা খুঁজে পেয়েছি আকর্ষণীয় কিছু অস্তিত্ব। ঠাকুরদালানটির বাইরের দেয়ালে এবং ভেতরেও বেশকিছু প্লাস্টারের মূর্তি সংলগ্ন, যেগুলি হিন্দু দেব-দেবীর হলেও, স্থাপত্যশৈলী এবং অলঙ্করণে পাশ্চাত্যের ছাপ স্পষ্ট। আশ্চর্য হতে হয় উনবিংশ শতকে বেলঘর গ্রামের এক জমিদারবাড়িতে নির্মিত এইসব নিদর্শন দেখে। দুর্গা দেবী’র কাছ থেকেই জানতে পারেছি, অন্তত ১৯৮০ পর্যন্ত ঠাকুরদালানটি ব্যবহৃত হত, কালের করাল গ্রাসে পরিত্যক্ত হয়ে বর্তমানে এই দশা। পুরোপুরি ধ্বংসপ্রাপ্ত হতে খুব বেশি দেরি নেই।

    ভুবনমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িটির অবশিষ্টাংশ দেখে আন্দাজ পাওয়া যায় প্রাচীন বিশালতার। রাস্তার ওপরেই বিশাল লোহার গেট, দু’পাশে দাড়োয়ানের দেউড়ি, সামনে বিস্তৃত ফুলের বাগান এবং তার পরেই আর্চ-আকৃতির দরজা পেরিয়ে ভিতরে প্রবেশ। এখন সেই দরজাও নেই, লোহার গেটও নেই। প্রোমোটারের কবলে সবটাই ভাঙা পড়ছে একে একে। নলিনী দেবী’র দশ সন্তানের মধ্যে নগেন্দ্রনাথের সম্পত্তি ভাগ হওয়ার পর সম্ভবত দুর্গা দেবী’র স্বামী বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর অংশটুকু ছাড়া বাকি সবটাই হস্তান্তরিত হয়েছে। সেখানে ইতিমধ্যেই পুরোনো বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট উঠেছে। অদম্য জেদের বশে দুর্গা দেবী নিজের অংশটুকু ধরে রেখেছেন আজও। 
    সুরেন্দ্রনাথের অংশ অবশ্য এখনও বর্তমান। জানি না, কতদিন আর দেখতে পাওয়া যাবে প্রাচীন এই বাড়িটির অবশিষ্ট কাঠামোটুকু। বেলঘরিয়ার ইতিহাসের অন্যতম শেষ নিদর্শনও হারিয়ে যাবে সেদিন...

    সূত্র ‘বেলঘরিয়ার ইতিহাস সন্ধানে’
    প্রকাশক – আরশিনগর প্রাণভূমি
    প্রকাশকাল – ২০১৬

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @