বাঙালির স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র গড়ার বিশেষ ভূমিকায় ছিলেন সনজীদা খাতুন

তাঁর জীবন ও কর্মের সাধারণ বিবেচনায় স্পষ্ট হবে, তিনি এক সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পথ চলেছেন। তিনি চেয়েছেন স্বদেশে প্রতিজন যেন তাঁর বাঙালি জাতিসত্তাকে হৃদয়ে ধারণ করে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে বিকশিত হোক, গড়ে উঠুক এক মানবিক সমাজ। এ কাজে তাঁর প্রধান কর্মক্ষেত্র ও অবলম্বন ছিল সংগীত ও শিক্ষা, বিশেষত শিশু শিক্ষা। এজন্য তিনি প্রেরণা লাভ করেছেন প্রধানত রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি থেকে, যা তিনি আত্মস্থ করেছেন প্রাণভরে। আজীবন সাধনা করেছেন বাংলা গানের - তার চর্চা, অনুশীলন ও সর্বজনে বিস্তারের জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা করেছেন। তিনি বিপরীত স্রোতের মানুষ, চেয়েছেন তাঁরা যেন বিনোদন তারকা নয়, শিল্পী হয়ে উঠে। তাঁরা গানের বাণীকে উপলব্ধি করে যথাযথ সুরে গানটি পরিবেশন করবে, তার অনুভবের অংশ হবে। নিখুঁত রূপে প্রকাশে অটল ছিলেন শুদ্ধতার প্রতীক এই গুণী মানুষটি। সংস্কৃতির সকল প্রকাশের বাণিজ্যিকরণের যুগে কাজটি সহজ নয়।
পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের দুই অংশের জনগণের ঐক্যসূত্র কেবলই ধর্ম। শুরুতে পূর্ব বাংলা, ছাপান্নোর সংবিধানে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী, রাজনীতির মানুষরা বাদ সাধলেন, তারা বাঙালি পরিচয়কে মুখ্য করে তুললেন। ছাত্রী সনজীদা খাতুন তখন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে রাজপথে।
দেশে-বিদেশে তাঁর লক্ষাধিক ছাত্রছাত্রী সকলে শিল্পী হয়ে উঠেনি, তবে প্রতি জন অন্তত নিজেকে ও সম্ভব হলে পরিবারকে বাঙালি রূপে চিহ্নিত করেছে, বাংলা গানের অনুরাগী রয়েছেন। কেবল সংগীত সাধক, শিক্ষক হিসেবে সনজীদা খাতুনের বিবেচনা সঙ্গত নয়। তিনি যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জসীমউদ্দিন শিক্ষাদান করেছেন, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের উপর বিশ্বভারতীতে অভিসন্দর্ভ রচনা করে বিদগ্ধজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, সর্বোপরি সারাটি জীবন যে রবীন্দ্রনাথের সকল সৃষ্টি নিয়ে আপন জ্ঞান সর্বজনের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন, এ সব কিছু তাঁর কর্ম ও জীবনের মূল লক্ষ্য অর্জনের পথ পরিক্রমার অংশ। এ পথ মসৃণ ছিল না, কিন্তু তিনি স্থির প্রত্যয়ে যাত্রা থেকে কখনও বিরত হননি।
অবশ্য এ ধারার কাজ তাঁর আপন স্বদেশ ভূমিতে কতটা প্রয়োজনীয় ও গুরুত্ববহ ছিল এবং আজও প্রাসঙ্গিক রয়েছে, তার আলোকেই সনজীদা খাতুনের কর্ম ও জীবনকে বিবেচনায় নিতে হবে।
উপমহাদেশের রাষ্ট্র, সমাজ ও প্রতিজনের চিন্তা-মননে ঐতিহাসিক ভাবে সর্বাধিক প্রভাব রেখেছে ধর্ম বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি, তার জের আজও আমরা বহন করছি। দেশভাগ ঘটেছিল ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির তাড়নায়। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের দুই অংশের জনগণের ঐক্যসূত্র কেবলই ধর্ম। শুরুতে পূর্ব বাংলা, ছাপান্নোর সংবিধানে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী, রাজনীতির মানুষরা বাদ সাধলেন, তারা বাঙালি পরিচয়কে মুখ্য করে তুললেন। ছাত্রী সনজীদা খাতুন তখন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে রাজপথে। বাড়তি সুবিধা একটি পেয়েছিলেন। বাবা কাজী মোতাহার হোসেন মুক্তচিন্তার অন্যতম দিশারি, কাজী নজরুল ইসলাম যাঁকে মতিহার বলে বন্ধু মেনেছিলেন, যিনি দেশভাগের ধর্মীয় উন্মাদনার মধ্যে বলেছিলেন, “সংস্কৃতি শিক্ষিতজনের ধর্ম”। ধর্মে সংগীত নিষিদ্ধ - এ প্রাচীন ধারণা মুসলিম পরিবারে পাকিস্তান সৃষ্টিতে গতি পেয়েছে, গুণী মুসলমান সংগীতজ্ঞরা অনুকূল পরিবেশের অভাবে দেশত্যাগ করেছেন। এমন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সনজীদা খাতুনেরা শূন্য থেকে যাত্রা শুরু করেছেন।
সনজীদা খাতুন তথা ছায়ানট বিশ্বাস করে বাঙালি জাতিসত্তাকে ধারণ করা যথেষ্ট নয়, পরিপূর্ণ মানুষ গড়ার সাধনার প্রয়োজন, প্রয়োজন সম্প্রীতির সমাজ প্রতিষ্ঠা, বিশ্বায়নের যুগে বিশ্বমানব হওয়া।
১৯৬১ সালে প্রতিরোধের মুখে রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী পালন থেকে পথচলার সূচনা, সে বছর শীতে তাঁরা প্রতিষ্ঠা করলেন ছায়ানট, নিয়মিত আয়োজন ঋতু উৎসব ও পুরোনো বাংলা গানের আসরের। তবে শিল্পীর বেশ অভাব। সে সংকট পূরণে ১৯৬৩-তে জন্ম নিল ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তন, আজ সেটি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ সংগীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় চার হাজার। ১৯৬৭-তে ছায়ানট আয়োজন করলো সংগীতের আবহে রমনার বটমূলে নববর্ষ, যা পরিণত হয়েছে বাঙালির একমাত্র অসাম্প্রদায়িক উৎসবে। তখন নববাঙালির স্বাধীকার আন্দোলনের জোয়ার বইছে। রমনার বটমূলেও স্থান সংকুলান হয় না। তখন শাসকরাও দীর্ঘমেয়াদী শত্রুকে চিনেছে। রবীন্দ্রসংগীত তথ্য মাধ্যমে নিষিদ্ধ হল। প্রতিবাদীদের মাঝে বড়ো জায়গা জুড়ে ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতারা। সনজীদা খাতুন সরকারি কলেজে শিক্ষকতা করেন, তাকে বদলি করা হলো সুদূর রংপুরে। এর ধারাবাহিকতায় রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের যুগলবন্দি দেশকে মুক্তিযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিল। তিনি দেশত্যাগ করে উদ্বাস্তু শিল্পীদের সংগঠিত করে গড়ে তুললেন মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা। তারা উদ্বাস্তু, শিবির ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গান গেয়ে উজ্জীবিত করে চলে।
বাঙালি মুসলমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করার কর্তব্যে ব্রতী সংস্কৃতিজনদের অগ্রসর অংশের অন্যতম সনজীদা খাতুন। এভাবে বাঙালির স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র গড়ার বিশেষ ভূমিকায় ছিলেন সনজীদা খাতুন। স্বাধীন দেশে বাঙালি সংস্কৃতির যাত্রাপথ নির্বিঘ্ন হল, ভারতের সংস্কৃতি সাধনার বিশেষ প্রতিষ্ঠান থেকে উত্তীর্ণ শিল্পীদের যুক্ততায় সংস্কৃতির সকল মাধ্যমে গতি সঞ্চারিত হল। ছায়ানট এতদিন উদ্বাস্তু জীবন যাপন করেছে। সরকারের বরাদ্দ জমিতে কোনো সরকারি বা বিদেশি অনুদান নয়, আপন অর্থায়নে ও সর্বজনের সহায়তায় গড়ে উঠলো ছায়ানট সংস্কৃতি ভবন। তবে, উগ্রবাদী অপশক্তিরা সইবে কেন?
২০০১ সালে রমনার বটমূলে নববর্ষের আয়োজনে বোমা বিস্ফোরণ হয়। কিন্তু সনজীদা খাতুনের ভাষায় “আমরা ত্রস্ত তবে সন্ত্রস্ত নই”। পরের বছর থেকে অধিকতর উৎসাহে চলেছে এ অনুষ্ঠান। তিনি তাঁর জীবন গ্রন্থে জানাচ্ছেন, এ ঘটনা থেকে উপলব্ধি, আরও গভীরে, গোড়া থেকে কাজ করতে হবে। প্রতিষ্ঠিত হল সংস্কৃতি সমন্বিত শিশু শিক্ষা কার্যক্রম নালন্দা বিদ্যালয়, ঢাকার অদূরে তার নিজস্ব ভবন নির্মিত হয়েছে। ছায়ানটের সকল আয়োজন রাজধানীতে। তাই সারা দেশে বিস্তৃতির লক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথকে প্রধান অবলম্বন করে আবহমান বাংলা গানের অনুশীলন ও পরিবেশনার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জাতীয় রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদ। সারা দেশজুড়ে তার সত্তরটি শাখা, মহাসমারোহে এক বছর রাজধানীতে ও অপর বছর অন্য কোনো শহরে সংগঠিত হয় জাতীয় সম্মেলন। সনজীদা খাতুন তথা ছায়ানট বিশ্বাস করে বাঙালি জাতিসত্তাকে ধারণ করা যথেষ্ট নয়, পরিপূর্ণ মানুষ গড়ার সাধনার প্রয়োজন, প্রয়োজন সম্প্রীতির সমাজ প্রতিষ্ঠা, বিশ্বায়নের যুগে বিশ্বমানব হওয়া। আর তাই সনজীদা খাতুন ব্রতচারী সংসদের নেতৃত্ব দিয়েছেন, উনি গুরুসদয় দত্তের বাণীকে ধারণ করেছেন, “বিশ্বমানব হবি যদি সম্পূর্ণ বাঙালি হ”। নালন্দার শিশুদের ব্রতচারী শিক্ষা অবশ্য পালনীয়।
পরাধীন আমল থেকে এই পরিকল্পিত বিপুল কর্মযজ্ঞ একক নেতৃত্ব সনজীদা খাতুন কখনও দাবি করেননি। সকল কাজের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন হয়েছে সংগীতগুণী প্রাজ্ঞ সংগঠক ওয়াহিদুল হক ও সনজীদা খাতুনের উদ্যোগে। এ কৃতিত্ব উভয়ের। তবে, ২০০৭ সালে ওয়াহিদুল হকের মৃত্যুর পর গত আঠারো বছর সনজীদা খাতুনকে একা হাল ধরতে হয়েছে। বয়স ও অসুস্থতার কারণে একেবারে অসামর্থ্য হওয়ার পূর্বমূহূর্ত অবধি সংগঠন প্রতিটি বিষয়ে তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল।
সনজীদা খাতুন দেশের এক ক্রান্তিলগ্নে প্রয়াত হলেন। গত কয়েক দশক ধরে ধর্মীয় নবতর ব্যাখ্যার বিস্তার ও বিশ্বায়নে প্রভাবের মিশ্রণের ফলে সমাজ ও ব্যক্তি পর্যায়ে বহুজনের জীবনাচার ও চিন্তাধারায় বিপুল পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। রাষ্ট্রীয় ভাবেও তার প্রভাব লক্ষণীয়। এ পরিবর্তনের সাংস্কৃতিক অভিঘাত দৃশ্যমান। এ পরিস্থিতিতে সনজীদা খাতুনের সক্রিয় উপস্থিতি একান্ত প্রয়োজন ছিল।