No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    ধর্মীয় প্রতীক সরে গিয়ে প্রকৃতির ছায়া স্পষ্ট হয়ে উঠেছে শান্তিনিকেতনের আলপনায়

    ধর্মীয় প্রতীক সরে গিয়ে প্রকৃতির ছায়া স্পষ্ট হয়ে উঠেছে শান্তিনিকেতনের আলপনায়

    Story image

    আলপনার সৃজনে মগ্ন শিল্পী সুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায় 

    আলপনা বলতে আমার মনে দুটি ভিন্ন চিত্র ভেসে ওঠে। একটিতে দেখি কোনো গৃহবধূ পিটুলিগোলায় হাত ডুবিয়ে টেনে চলেছেন সাদা রেখার নকশা। কলমিলতা, শঙ্খলতা ও খুন্তিলতার ঘেরাটোপে তার চাওয়াপাওয়া ও আশা-আকাঙ্ক্ষার ছবিগুলি সাজিয়ে রাখছে। অন্য একটি চিত্রে দেখি এক আশ্রম বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা তাদের চারপাশের গাছপালা লতাপাতারই সৌন্দর্যরূপ আলপনার রেখায় রেখায় ফুটিয়ে তুলছে। গৃহবধূর আলপনা তাদের জীবনযাপনের অঙ্গ। তাদের প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে পুজোপার্বণ ও ব্রতপালন জড়িয়ে আছে এবং সেই সূত্রে আলপনা দেওয়ার মধ্যে তাদের সচেতন কোনো শিল্পসৃষ্টির তাগিদ প্রাধান্য পায় না। চিরাচরিত আলংকারিক নকশার মধ্যে দেবদেবী ও অন্যান্য প্রতীকচিহ্নগুলি আলপনার টানে ফুটিয়ে তোলার মধ্যে স্বশিক্ষিত শিল্পপ্রচেষ্টা থাকলেও ব্রতের মধ্যে মনস্কামনা পূরণই ছিল তাদের স্বপ্ন। লোকায়ত আলপনার এই সৌন্দর্য, জলধারার মতোই সহজ ও সুন্দর।

    সুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের আলপনা চিত্র - ১ 

    শান্তিনিকেতনের আলপনার ইতিহাস বড়োজোর একশো বছরের কিছু বেশি। আলপনার এই দ্বিতীয় চিত্রে আমরা দেখে ১৯০৯ সালের ঘটনা, যেখানে আর এক ইতিহাস রচনা হতে চলেছে। শিল্পী নন্দলাল বসু তখন যুবক। তাঁর মনে তখন দেশজ শিল্প ও অলংকরণের প্রতি আসক্তির গভীর ফল্গুস্রোত বয়ে চলেছে। ক্ষয়িষ্ণু ভারতশিল্প পুনরুদ্ধারে ব্রতী দুই বিদেশিনী ভগিনী নিবেদিতা ও লেডি হেরিংহাম নন্দলাল বসু ও অসিত হালদারকে একরকম প্রায় জোর করেই অজন্তা পাঠিয়ে দিলেন। উদ্দেশ্য, এই দুই শিল্পীকে দিয়ে অজন্তার নষ্ট হতে থাকা গুহাচিত্রগুলি কপি করা। অজন্তা যেতে সম্পূর্ণ অনিচ্ছুক নন্দলাল শেষ পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়ালেন সেই ছবিগুলির সামনে। বিস্ময়ে অভিভূত নন্দলাল স্বগতোক্তি করলেন, যে তিনিই পূর্বজন্মে অজন্তার গুহাচিত্রের শিল্পী ছিলেন। অতীত চিত্রের ভাস্কর্যসম রেখার বাঁকে ও অলংকরণের কারুকার্যের সঙ্গে এক গভীর একাত্মবোধে মিশে গেলেন। বহু যুগের ওপার হতে অপেক্ষারত এইসব গুহাচিত্র ও নকশার ছন্দ তাঁর হাতে পুনর্জন্মের জন্য যেন অপেক্ষা করছিল। শান্তিনিকেতনের আলপনার মধ্যে সেই পুনর্জন্মের ইতিহাস রচিত হলেও তার ঠিক আগেই রয়ে গেছে শিল্পীর আর এক অভিজ্ঞতায় যাত্রাপথ। ১৯০৮ সালে উড়িষ্যা থেকে শুরু করে দক্ষিণ ভারতের উল্লেখযোগ্য নানা মন্দিরের ভাস্কর্যে দেবদেবীর দৈহিক বিভঙ্গ ও অলংকরণ দেখতে দেখতে তাঁর মন পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। তিনি বুঝে নিলেন, কীভাবে প্রকৃতি, মানুষ, পশুপাখির আলংকারিক রূপের সঙ্গে বিশুদ্ধ নকশা একাকার হয়ে গেছে। এই উপলব্ধি পরবর্তীকালে তাঁর ছবি এবং অলংকরণের ক্ষেত্রেও এক উন্মোচন ঘটাল। 

    সুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের আলপনা চিত্র - ২ 

    ১৯১৯-এ রবীন্দ্রনাথের ডাকে নন্দলাল শান্তিনিকেতনে কলাভবনের দায়িত্ব নিলেন। ততদিনে সেখানে আলপনার ইতিহাস গড়ে উঠেছে ক্ষিতিমোহন সেনের বৈদিক আদর্শকে ভিত্তি করে, তাঁর স্ত্রী কিরণবালা দেবীর হাত দিয়ে। এরপর রবীন্দ্রনাথ আলপনার সর্বাঙ্গীন দায়িত্ব নিতে গ্রাম থেকে বাল্যবিধবা সুকুমারী দেবীকে আনালেন। গ্রামবাংলার আলপনায় দক্ষ সুকুমারী দেবীর পিটুলিগোলার পাত্রে হাত ডুবিয়ে নন্দলাল আঁকলেন নতুন আলপনা, যে আলপনায় ধর্মীয় প্রতীক সরে গিয়ে প্রকৃতির ছায়া স্পষ্ট হয়ে উঠল। রবীন্দ্রনাথ ঠিক এটাই চেয়েছিলেন। তিনি লিখেওছিলেন যে ঈশ্বর যেখানে প্রকৃতির অনন্ত রূপের মধ্যেই বিরাজমান, সেখানে শিল্পী কি আলপনা আঁকবে না? নন্দলাল গাছপালা ও লতাপাতা থেকেই সংগ্রহ করলেন একের পর এক সৌন্দর্যসূত্র, তৈরি করলেন নকশার মোটিফ, গড়লেন নতুন কাঠামো আর এভাবেই জন্ম হল শান্তিনিকেতনের আলপনার। নন্দলালের উপলব্ধি প্রকাশিত হল এইভাবে –   

    “আলপনা সুন্দর হয় গতির সামঞ্জস্যে – ঠিক নাচের মতো”। 

    “আলঙ্কারিক রূপকল্পনার প্রাণ হল spiral। প্রাণছন্দ। তাকে ধরেই রূপের ক্রমবিকাশ”।

    সুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের আলপনা চিত্র - ৩

    এভাবে তিনি আলপনা সম্পর্কে প্রচলিত ধ্যান-ধারণার মূল স্রোত থেকে এক স্রোতস্বিনী শাখানদীর জন্ম দিলেন। আলপনার ভাবনায় নির্মাণ ও সৃজনকে গুরুত্ব দিলেন। সেখানে আলপনার কাজে যোগ দিলেন তাঁরই কন্যা গৌরী ভঞ্জ ও যমুনা সেন। এলেন ইন্দুসুধা ঘোষ, চিত্রনিভা চৌধুরী, ননীগোপাল ঘোষ – যাঁরা নন্দলালের ভাবাদর্শে শান্তিনিকেতনের আলপনাকে সমৃদ্ধ করতে থাকলেন। নন্দলাল যেমন ছবিতে আলংকারিক বিন্যাসের উপদেশ দিলেন, তেমনই প্রতিভাময়ী শিল্পী গৌরী ভঞ্জ ছবির মতো আলপনার ক্ষেত্রেও ভূমি বিভাজন, কাঠামো নির্মাণ ও সামগ্রিক ভারসাম্য রক্ষার ওপরে জোর দিলেন। 

    দুর্গাপুজোর মণ্ডপসজ্জায় শান্তিনিকেতন ধারার আলপনা | ভিডিও সৌজন্যে - Get Bengal 

    ১৯৭৫-এ আমি শান্তিনিকেতনে এলাম এবং তখনও সে আলপনার যে রূপ দেখেছিলাম, তার দ্বারা প্রভাবিত হলাম বিধাতার কি নির্দেশে! ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে আশ্রমের উৎসব অনুষ্ঠানে আলপনার কাজ করতে করতে এক গভীর নান্দনিক অনুসন্ধানের পথ হাঁটতে থাকলাম। এই আলপনার অতীত গৌরবময় যুগের কথা বুঝে নিতে বিশ্বভারতী আর্কাইভের দ্বারস্থ হলাম। ক্রমশ বুঝলাম, শান্তিনিকেতন ধারার আলপনার মধ্যে একজন শিল্পী তার শৈল্পিক চিন্তাভাবনা ও মণ্ডনশিল্পের চিত্রগত ভাবনার প্রয়োগ ঘটাতে পারেন। নব নব রূপের আদর্শ সৃষ্টি করা যেতে পারে। এ আলপনা চিত্রকরের আলপনা। শান্তিনিকেতনের আলপনার ধারা সম্পর্কে আমার অনুভব ও ভাবনার কিছু সূত্র এখানে রাখলাম। 

    সুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের আলপনা চিত্র - ৪   

    ঋতু পরিবর্তনজনিত কারণে পরিবর্তমান প্রাকৃতিক দৃশ্যরূপের মধ্যেই আছে আলপনার ইশারা ও ইঙ্গিত। এ এক বিচিত্র নান্দনিক অভিজ্ঞতা। সামান্য ঘাস থেকে অনন্ত মহাকাশ পর্যন্ত বিছানো রয়েছে নকশা নির্মাণের অশেষ সম্ভাবনা। 

    প্রকৃতির বাস্তব রূপ ও তার থেকে গড়ে তোলা আলংকারিক রেখার মধ্যে একটা সামঞ্জস্য আনতে হবে। প্রকৃতির আকার ও প্রাণছন্দকে আলপনার অন্তর্লীন সৌন্দর্যে বইয়ে দিতে হবে। গাছপালার গঠনের মধ্যে যে আনন্দতরঙ্গ শিল্পী প্রত্যক্ষ করে, তার সঠিক ornamentation-এর ভাবনা থেকে গড়ে ওঠে প্রাণতরঙ্গে ভরপুর এক আলপনা। 

    সুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের আলপনা চিত্র - ৫   

    শিল্পের ছাত্র হিসেবে বিদেশের যে সব মহান শিল্পীদের কাজের সঙ্গে আত্মীয়তা গড়ে তুলেছিলাম, আজ আলপনা আঁকতে বসে তাঁদের চিত্রনির্মাণ ভাবনা আমাকে প্রতিনিয়ত এগিয়ে দেয়। ইউরোপের শিল্পী পল সেজানের ছবিতে প্রকৃতির পুনর্নিমাণ ও দৃঢ় গঠনচিন্তা, ভ্যান গঘের ছবিতে তুলিচালনার চক্রাকার (spiral) গতি, পিকাসোর ছবিতে যাবতীয় রূপের বিনির্মাণ ও নির্মাণ এবং জাপানি শিল্পী হোকুশাইয়ের ছবিতে বিশ্বচরাচরের মধ্যে পঞ্চভূতের (জল, স্থল, অগ্নি, আকাশ, বাতাস) যে নান্দনিক প্রকাশ – এ সবই আলপনার অন্তর্নিহিত চিন্তাভাবনা। 

    আলপনা আঁকছেন শিল্পী সুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায় 

    স্থাপত্যগুণ ও জ্যামিতিক ভিত্তি আলপনার লাবণ্যময় অলংকরণকে সংহত করে, দৃঢ় করে। ঢেউয়ের মতো গতিরেখা, বক্ররেখা, বৃত্ত, অর্ধবৃত্ত – এসবের সঙ্গে টানটান কয়েকটি সরলরেখার কাঠামো আলপনার দৃশ্যগ্রাহ্যতা আরো জোরদার করে।

    শিল্পী পার্থ দাশগুপ্ত এবং শিল্পী সুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায়

    শান্তিনিকেতনের আলপনা দক্ষ ড্রইং ও যথাযথ আলংকারিক ভাবনায় পরিশীলিত এক শিল্পরূপ। এক অভিজাত পবিত্র সৌন্দর্যের আধার এই আলপনা। রবীন্দ্রসংগীতের মধ্যে প্রকৃতির যে অফুরন্ত রসের স্রোত বহমান, তার চিত্ররূপ যেন দেখতে পাই আলপনায়। একদিকে গভীর জীবনবোধ, অন্যদিকে একমেবাদ্বিতীয়ম্ ঈশ্বরের প্রতি আত্মনিবেদনের দ্যোতনা ফুটে ওঠে শান্তিনিকেতনের আলপনায়। এভাবেই সচল, সজল, বহমান নদীর মতোই এই আলপনার ধারা এগিয়ে যাবে তার ঐতিহ্যের উৎসের সঙ্গে যোগ রেখে। 
     

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @