No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    পরিবর্তনের জোট এবং এবারের একুশে জুলাই

    পরিবর্তনের জোট এবং এবারের একুশে জুলাই

    Story image

    জ থেকে ঠিক পাঁচ বছর আগের কথা। ২০১৮-র ২১ জুলাই ছিল এবারের মতোই পঞ্চায়েত ভোট এবং লোকসভা ভোটের মধ্যবর্তী তৃণমূল কংগ্রেসের একটা কর্মসূচি। সেখান থেকেও তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১৯-এ বিজেপির পতন হবে বলে ঘোষণা করেছিলেন, ফেডারেল ফ্রন্টের কথা বলেছিলেন। সমান ভাবে আক্রমণ করেছিলেন বাংলার বিজেপি, কংগ্রেস এবং সিপিএমকে। একথাও বলেছিলেন, বিজেপি আরএসএসের মধ্যে অনেক ভালো লোক আছেন। যদিও তিনি যা যা বলেছিলেন, ইতিহাস বলছে, ঘটনা সেই পথে এগোয়নি।

    গত শুক্রবার, পাঁচ বছর পর ২০২৩-এর ২১ জুলাই। এক অন্য মমতাকে দেখা গেল। এর মধ্যে অবশ্য জাতীয় রাজনীতিতে একটা পরিবর্তনের ইঙ্গিত কিছুটা স্পষ্ট হয়েছে। ২৬ দলের বিরোধী জোট I.N.D.I.A. গঠিত হয়েছে। অন্য দিকে ৩৮টি রাজনৈতিক দল নিয়ে আচমকাই সামনে এসেছে নতুন করে বিজেপির নেতৃত্বে এনডিএ। এত দিন এনডিএ-র প্রায় কোনও অস্তিত্বই ছিল না। I.N.D.I.A.-র জন্ম হতে না হতেই দেখা গেল বেঁচে উঠেছে এনডিএ। যাই হোক দু’পক্ষের শক্তি যোগ করলে দাঁড়ায়  মোট ৫৬টি রাজনৈতিক দল। ৫৬টি রাজনৈতিক দল দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে ভারতীয় রাজনীতিতে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। এরকম আগে হয়নি। এক পক্ষ হিন্দুত্ববাদী।বিপরীত পক্ষ ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলছে। এটা একটা বড়ো পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের আবহেই দেখতে হবে তৃণমূল কংগ্রেসের ২১ জুলাই কর্মসূচিকে।

    ১৯৭৭-এও এরকম হয়েছিল। কিন্তু তখন ইন্দিরার বিরোধী দলগুলি কৌশলগত কারণে একজোট হলেও, তারা আদর্শগত ভাবে এক ছিল না। এবারে ব্যতিক্রম এটাই যে, হিন্দুত্ববাদী এবং ধর্মনিরপেক্ষ, গোদা ভাবে হলেও, এরকম দুটি স্পষ্ট পক্ষ তৈরি হয়েছে। যদিও এই ধর্ম নিরপেক্ষ শক্তির ভবিষ্যৎ এখনও অস্পষ্ট। এ বছরের শেষে পাঁচটি বিধানসভা নির্বাচনের ফলের উপর অনেকটাই  নির্ভর করবে ভারতে ধর্ম নিরপেক্ষ রাজনীতির ভবিষ্যৎ। তাছাড়া অনেক আঞ্চলিক দল সমস্যায় পড়লে তারা যে তাদের ধর্ম নিরপেক্ষ অবস্থান ছেড়ে বিজেপির দিকে চলে যেতে পারে, এমন নজির অতীতে রয়েছে। নেতারা তো নীতির বালাই ভুলে নিয়মিতই যাচ্ছেন এধার ওধার।

    গত শুক্রবার ২১ জুলাই মমতার ভাষণে দেখা গেল, একবার তিনি ‘সিপিএম ভাইদের’ উদ্দেশে কিছু কথা বললেন বটে, কিন্তু তাঁর আক্রমণ ছিল পুরোটাই বিজেপির বিরুদ্ধে। কংগ্রেস-সিপিএমকে তিনি জাতীয় রাজনীতির স্বার্থে কিছুটা ছাড় দিলেন বলেই মনে হল। এটা হল I.N.D.I.A. পরবর্তী রাজনীতি।

    ২০১৮-তে এবং তার আগেও, বিভিন্ন পঞ্চায়েত ভোটে এই রাজ্যে হিংসা হয়েছে। কখনও কখনও ২০২৩-এর থেকে বেশিই হয়েছে। কিন্তু অতীতে কোনও রাজনৈতিক দলের নেতাকে, কোনও মুখ্যমন্ত্রীকে, হিংসার জন্য দুঃখ প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। ১৯৯৩-র ২১ জুলাই জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন এই যে ১৩ জন গরিব পরিবারের যুবককে রাস্তার উপর গুলি করে মারা হয়েছিল, তার জন্য সিপিএম কোনও দিন দুঃখ প্রকাশ করেনি। বিধান রায়কেও কেউ কখনও দুঃখ প্রকাশ করতে শোনেননি পুলিশের লাঠিতে খাদ্য আন্দোলনের মিছিলের কৃষকদের পিটিয়ে মারার জন্য। নরেন্দ্র মোদীকে যখন সাংবাদিক করণ থাপার এক সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন করেছিলেন, তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্বের সময় সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে হাজারের বেশি মানুষের মৃত্য হল, তিনি কি দুঃখিত? গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ক্রুদ্ধ নরেন্দ্র মোদী মাইক সরিয়ে রেখে ইন্টারভিউ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। মণিপুরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দলের ডবল ইঞ্জিন সরকার। প্রধানমন্ত্রী মণিপুর নিয়ে মুখ খুলতে সময় নিয়েছেন ৭৯ দিন। অনেক পরে হলেও কংগ্রেস অবশ্য শিখ বিরোধী দাঙ্গার জন্য, জরুরি অবস্থার জন্য ক্ষমা চেয়েছে। রাজনীতি এবং মানবিকতার মধ্যে যদি কোনও সম্পর্ক থাকে, এইখানেই কংগ্রেস কিছুটা হলেও এগিয়ে অন্যদের থেকে। এই যে জ্যোতি বসুর মুখ্যমন্ত্রিত্বে ১৩ যুবককে পুলিশ গুলি করে মেরেছিল ৩০ বছর আগে, বাংলা তোলপাড় হয়েছিল, কিন্তু জ্যোতি বসু যে বিষয়টিকে মোটেই গুরুত্ব দেননি, তার একটা প্রমাণ, তাঁর যে আত্মজীবনী ‘যত দূর মনে পড়ে’, সেখানে এই নিয়ে একটি শব্দও নেই। ‘অথারাইজড বায়োগ্রাফি’, সুরভী বন্দ্যোপাথ্যায় জ্যোতি বসুর যে জীবনী লিখেছিলেন, সেখানেও এই ঘটনার কোনও উল্লেখ নেই।

    ১৯৭৭-এও এরকম হয়েছিল। কিন্তু তখন ইন্দিরার বিরোধী দলগুলি কৌশলগত কারণে একজোট হলেও, তারা আদর্শগত ভাবে এক ছিল না। এবারে ব্যতিক্রম এটাই যে, হিন্দুত্ববাদী এবং ধর্মনিরপেক্ষ, গোদা ভাবে হলেও, এরকম দুটি স্পষ্ট পক্ষ তৈরি হয়েছে। যদিও এই ধর্ম নিরপেক্ষ শক্তির ভবিষ্যৎ এখনও অস্পষ্ট। এ বছরের শেষে পাঁচটি বিধানসভা নির্বাচনের ফলের উপর অনেকটাই নির্ভর করবে ভারতে ধর্ম নিরপেক্ষ রাজনীতির ভবিষ্যৎ।

    গত শুক্রবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ২১ জুলাইয়ের সভায় দেখা গেল পঞ্চায়েতে মৃত্যুর ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করলেন।এটা যদি কৌশলও হয়, তবুও সেটা ভালো। তবুও এটা একটা দৃষ্টান্ত। রাজনৈতিক নেতারা অন্তত এই কৌশলটুকু রপ্ত করুন, যদি মন থেকে নাও বলতে পারেন, কৌশল করেই বলুন। ভদ্রতার মধ্যে একটা যান্ত্রিকতা থাকে, কিন্তু সভ্য সমাজে সেটা দরকার। অবশ্যই ঠিক, এটুকুই যথেষ্ট নয়। মমতা ২০১১-র আগে অস্ত্রমুক্ত বাংলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সে কাজ তিনি এখনও শুরুই করতে পারেননি বা করেননি। তৃণমূলকর্মী বেশি মারা গিয়েছেন, এই অজুহাত দিয়ে প্রশাসনের ব্যর্থতা চাপা দেওয়া যায় না। সরকারের চোখে সব মানুষের প্রাণের মূল্য সমান হওয়া উচিত। ক্ষতিপূরণ আসলে কোনও ‘পূরণ’ নয়, সেটা আসলে অস্বস্তিকর বিষয় থেকে হাত ধুয়ে ফেলে সরকারের মুখ লুকোনোর একটা আড়াল মাত্র।  

    রাজনীতিতে একেকটা আন্দোলন থাকে যাকে পালা বদলের সূচনা বলা যায়। যেমন, ১৯৬৫-৬৬-র খাদ্য আন্দোলন। পরিণতিতে ১৯৬৭ থেকে পশ্চিমবঙ্গে পালা বদল স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করেছিল। ১৯৭৩-৭৪-এর জয়প্রকাশের নেতৃত্বে ইন্দিরা বিরোধী আন্দোলন। তিন দশকের কংগ্রেসের সাজানো বাগান তছনছ করে দিয়েছিল ১৯৭৭-এর ভোটে। বিদ্বেষের রাজনীতি, কিন্তু মানতেই হবে, ৯০-এর রাম মন্দির আন্দোলনও ঘটিয়েছে পালা বদল। ১৯৯৩-এর ২১ জুলাইও ঠিক সেরকমই একটা পরিবর্তনের মাইলস্টোন। যার পরিণতি, ২০১১-তে বামফ্রন্ট সরকারের পতন।

    এখানে যতগুলি পালা বদলের আন্দোলনের কথা বলা হল, তার সব ক’টির পিছনেই ছিল শক্তিশালী পার্টির ভূমিকা। কিন্তু ২১ জুলাইয়ের ক্ষেত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একক ভূমিকাই ছিল সব থেকে বড়ো।

    ২০২৩-এর ২১ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে বক্তৃতা দিলেন, তাতে তিনি হিন্দু পুজোর নানা মন্ত্র এবং খোদা হাফেজ ইত্যাদি, যা তিনি এর আগে প্রতিটি জনসভায় নিয়মিত বলে আসছিলেন, দেখা গেল তার কিছুই বললেন না। এটাও একটা পরিবর্তন। অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে, আপনি হিন্দুত্বের দিকে না ধর্মনিরপেক্ষতার দিকে। মমতা কিছুটা স্পষ্ট করলেন তাঁর অবস্থান ২০২৩-এর ২১ জুলাইয়ের বক্তৃতায়।  

    এটাও ঠিক, শুধু মমতা বললে হবে না। যারা I.N.D.I.A.-র পক্ষে তাদের সবাইকেই এই অবস্থানটা স্পষ্ট করতে হবে।ইডি, সিবিআইয়ের এর ভয়ে অনেক দল I.N.D.I.A.-র সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এটা বিজেপি বলছে। বিরোধী জোট সম্পর্কে নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, ভ্রষ্টাচারীদের সম্মেলন।উল্টোদিকে অসংখ্য নেতার নাম করা যায় যারা বিভিন্ন দল ছেড়ে বিজেপিতে গিয়েছেন এবং যাওয়ামাত্র তাদের সব পাপ ধুয়ে গিয়েছে। বিজেপিকে এখন বিরোধীরা বলে ‘ধোবিখানা’। কী শুভেন্দু কী হিমন্ত বিশ্বশর্মা, সকলেই একসময়ে বিজেপির চোখে ছিল দুর্নীতির মাথা। বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পরে তারা এখন বিজেপির তুলশিপাতা। এই রকম একটা পরিস্থিতিতে, যদিও আবছায়া দেখা যাচ্ছে, তবুও বোঝা যাচ্ছে, মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে হিন্দুত্ব এবং ধর্মনিরপেক্ষতা। রাজনৈতিক দলগুলিকেই ঠিক করতে হবে তারা কি এখন ছোটো ছোটো বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাবে, নাকি বৃহত্তর বিষয় নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কিন্তু তাদের একটা অবস্থান কিছুটা পরিষ্কার করেছে ২১ জুলাইয়ের সভায়। এখন দেখার বাকি রাজনৈতিক দলগুলি কে কী অবস্থান নেয়। কোনও সন্দেহ নেই এই মুহূর্তে ভারতের রাজনীতি একটা পরিবর্তনের মুখে দাঁড়িয়ে। কিন্তু সেই পরিবর্তন বাস্তবে কতটা হবে, তা কিছুটা স্পষ্ট হবে সামনের পাঁচ বিধানসভা ভোটের ফলের পর।

    ________
    *মতামত লেখকের নিজস্ব। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে আঘাত করা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @