স্কটিশ সাহেব, বাঙালি গির্জা আর ‘ডেঁপোমি’র আখ্যান

‘ডেঁপো’—এই শব্দে বাঙালির জন্মগত অধিকার। মানে, উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে জন্মানো বাঙালিদের। কারণ, ‘ডেঁপো’ শব্দের মতো ‘ডেঁপো’দের জন্মকাল উনিশ শতকের প্রথমার্ধ। আর, এই জন্মদানের মূলে রয়েছেন একজন গুরুগম্ভীর স্কটিশ। নাম আলেকজান্ডার ডাফ।
ডেঁপো শব্দের জন্ম কীভাবে দিলেন ডাফ সাহেব—সে গল্প বলব। কিন্তু, তার আগে ডাফ সাহেবকে নিয়ে যদি কিছু না বলি-- তাহলে ঘোরতর অন্যায় হবে।
কলকাতার স্মৃতিতে অনেক মানুষের ঠাসাঠাসি ভিড়। সেই ভিড়ে আছে ইংরেজ। আছে বাঙালি বাবুরা। আছে গ্রিক, আছে চিনা, আছে আর্মেনীয়। আর তারই পাশাপাশি উজ্জ্বল হয়ে আছে স্কটিশ।
কলকাতায় স্কটিশ গোরস্থান আছে। লন্ডননিবাসীদের দাপট শুধু নয়, এককালে কলকাতা সামলেছিল স্কট-দাপটকেও। কলকাতায় আসা স্কটিশ মিশনারিদের মধ্যে সবথেকে বেশি আলোচিত আলেকজান্ডার ডাফ। কলকাতার সমাজ-সংস্কারে তাঁর গভীর অবদানের চিহ্ন নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে ডাফ হাই স্কুল ফর গার্লস, স্কটিশ চার্চ কলেজ, ডাফ স্ট্রিট।
ডাফের স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে রয়েছে একটি গির্জাও। ঠিকানা- ১২৭ নম্বর শিশির ভাদুড়ি সরণী। মানিকতলার কাছেই। শিয়ালদা হয়ে মানিকতলা দিয়েও আসা যায়, আবার বিধান সরণি হয়েও। যে পথেই যান না কেন, ১৭১ বছরের বুড়ো গির্জা আপনাকে স্বাগত জানাবেই। কলকাতার নামজাদা গির্জাগুলির মতো অত ঢালাও পরিসীমা এর নেই। কিন্তু, তা বলে সে হেলাফেলার নয়। অনেক তর্কবিতর্ক, বাগবিতণ্ডার সাক্ষী হয়ে তো সে আছেই, আর আছে অনেকগুলি স্মৃতিকে আগলে।
সে বড়ো সুখের সময় কিনা তা নিয়ে ধন্ধ থাকলেও, সে কোনোভাবেই শান্তির সময় নয়। প্রতিদিনই শহরে নিত্যনতুন ঘটনা। হয় নতুন কোনো ইংরেজি স্কুল খুলছে। নয়তো কেউ সতীদাহর বিরোধিতা করছে। রোজই তর্ক বাঁধছে রাস্তাঘাটে। সাহেবের সংস্পর্শে হিন্দুধর্ম খোয়াবার ভয় রয়েছে যেমন, তেমনি রয়েছে সাহেবের পালকির পিছু পিছু দৌড়ে বেড়ানো-- ইংরেজি স্কুলে পড়ার আশায়। শোনা যায়, রামতনু লাহিড়ী ছেলেবেলায় ডেভিড হেয়ারের পালকি ধাওয়া করে বেড়াতেন, তাঁর ফ্রি-স্কুলে পড়তে চেয়ে। অথচ, একদিন হেয়ার সাহেব তাঁকে খাওয়ার কথা বললে, ধর্মচ্যুতির ভয়ে তিনি কাঁটা হয়ে ওঠেন। মোদ্দায় কলকাতায় তখন দুই-ই আছে, সহাবস্থানে। অবশ্য, এই দ্বিধা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টাও আছে পুরোদস্তুর। কলকাতার আয়তন তখন কম। সামান্য ঘটনাও ফুলকির মতো ছড়িয়ে যায়। তার ফলাফলে যে কোনো বিষয় ঘিরে কলকাতা দু-ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে সহজেই।
উনিশ শতকের প্রথমার্ধে কলকাতা তখনো পরিপূর্ণ শহর নয়। তার সমস্ত গ্রামীণ চিহ্নের ওপরেই জোরকদমে চলছে শহর গড়ার প্রস্তুতি। সেই প্রথম যুগেই কলকাতায় এসেছিলেন স্কটল্যান্ডের আলেকজান্ডার ডাফ। সেটা ১৮৩০ সালর মে মাস। হিন্দু কলেজ ততদিনে সুপ্রতিষ্ঠিত। ডিরোজিওর শিক্ষকতায় তাঁর ‘অকুতোভয়’ ছাত্ররা সমাজ-পরিবর্তনে সদা সচেষ্ট। ১৮৩০ সালের ফেব্রুয়ারিতেই তাঁরা প্রকাশ করেন ‘পার্থেনন’ নামের ইংরেজি সাপ্তাহিক। তাঁদের লম্ফঝম্পে গোটা সমাজে তখন বিপুল প্রতিক্রিয়া।
এরই মাঝে ডাফ সাহেব এলেন অন্য এক ঘরানার শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে।
রাজা রামমোহন রায়ের সঙ্গে বন্ধুতা হয়েছিল ডাফের। চিৎপুরে ইংরেজি শেখাবার জন্যে অবৈতনিক স্কুল খুলেছিলেন তিনি রামমোহনের সাহায্যেই। হিন্দু কলেজের কাছেই খ্রিস্টধর্মের প্রচার করতেন তিনি। ডাফের ভাবনায় সাড়া দিত ছাত্ররা। তাতে অবশ্য হিন্দু কলেজ কর্তৃপক্ষ ক্ষেপেও ছিল ডাফের ওপরে। ডাফ মিশনারি। শুধু লেখাপড়ার কথা তিনি বলতেন না। খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষাও দিতেন। সেজন্য দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গেও ঝামেলাতেও জড়িয়েছিলেন একবার।
আরও পড়ুন
যে স্কুলের ছাত্র ছিলেন রবীন্দ্রনাথ
কিন্তু সে যাই হোক, হিন্দু কলেজে যেমন ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া হত না (যদিও হিন্দুদের কলেজ), ডাফ তাতে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি মিশনারির আদবকায়দাই বজায় রেখে শিক্ষাবিস্তার করেছিলেন। ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে মুক্ত যুক্তিবাদী চিন্তাকে এদেশের মননে আনতে চেয়েছিলেন।
ডিরোজিওর ছাত্রদের মধ্যে অন্যতম কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৩২ সালের ১৭ অক্টোবর ডাফের কাছেই খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষা নেন। অবশ্য ডিরোজিওর মৃত্যুর পরে। আবার মধুসূদনের সঙ্গেও ডাফের যোগাযোগ ছিল বলে শোনা।
ডাফের তৈরি জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ-এর কথা আমরা জানি। যার পরবর্তী নাম স্কটিশ চার্চ কলেজ। আজও সে প্রতিষ্ঠান অতীতের মতোই সমুজ্জ্বল। হিন্দু কলেজের পাশাপাশি সম্ভ্রান্ত বাঙালি ঘরের অনেকেই পড়তে আসত এখানে। এমনকি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের পেছনেও হাত ছিল ডাফের। এসেছিল উপাচার্য হওয়ার প্রস্তাবও। ডাফ তা নাকচ করেন। এদেশের নারীশিক্ষার জন্যও স্কুল তৈরি করেছিলেন তিনি। অর্থাৎ, কলকাতায় ইংরেজ মিশনারিদের ভূমিকায় কিন্তু অবতীর্ণ হননি এই স্কটিশ মিশনারি। ধর্মপ্রচারের পাশাপাশি কলকাতাবাসীর সামাজিক উন্নতির দিকটিও ভালোই গুরুত্বপূর্ণ ছিল তাঁর কাছে।
সে জায়গা থেকেই নীল বিদ্রোহে চাষিদের পক্ষ নিয়েছিলেন ডাফ। নীলকরদের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। কিন্তু, এই আপাত সংস্কারমূলক কাজের মধ্যেও ডাফ কিন্তু ধর্মীয় ঘেরাটোপকে চিরকাল বজায় রেখে গেছেন। সে কারণেই বাঙালিটোলার অন্দরে তিনি তৈরি করেন একটি গির্জা। ১৮৪৮-এ। তখন তার নাম অবশ্য বেঙ্গলি গির্জা।
অন্যান্য চার্চগুলিতে সাহেবদের ভিড়ে এদেশীয় মানুষ জমা হতে পারত না। খ্রিস্টান হলেও নয়। ডাফ কিন্তু এদেশের লোকের জন্যই এবার চার্চ স্থাপন করলেন। বাংলাভাষা ভালোই জানতেন তিনি। বাংলাচর্চায় উৎসাহিতও করতেন। তাঁর চার্চেও এই ভাষার একটা প্রাধান্য রইল। আবার তথাকথিত শিক্ষিত হিন্দু বাঙালির খ্রিস্টানি-চর্চার দ্বারও উন্মুক্ত হল।
এই প্রসঙ্গেই ডেঁপো-র রসিকতা খুব চলতি ছিল। ডাফের ছাত্র তথা শিষ্যরা অধিকাংশই ছিলেন তার্কিক বাঙালি খ্রিস্টান। যুক্তিবোধ ছিল তাদের মজ্জাগত। আবার ধর্ম বিষয়েও তাঁরা ছিলেন স্পর্শকাতর। তাই, কলকাতার নিন্দুকেরা তাঁদের নাম দিল ‘ডেঁপো’। ডাফ সাহেবের শিষ্যদের জন্য আবিষ্কৃত এই শব্দটি যে এরপর আপামর বাঙালি কিশোর-তরুণের বিশেষণ হয়ে পড়বে, তা আর কে জানত!
এভাবেই কলকাতা তৈরি হচ্ছিল অনেকগুলি নৌকায় পা দিয়ে। তর্কেতর্কে তাই প্রতিদিন সরগরম থাকত কর্নওয়ালিস স্ট্রিট থেকে হ্যারিসন রোড। আজ মনে হয়, সেযুগের তর্ক তাও ভালো। অসংখ্য প্রশ্ন ও তার অবিরাম উত্তর খুঁজে চলার চেষ্টায় তাও হয়তো নতুন কিছুর সন্ধান মিলতে পারে। কিন্তু এই সময়টা, তার দুর্ধর্ষ আধুনিকতা নিয়ে সমস্ত প্রশ্নকে দুরমুশ করতে যেন বদ্ধপরিকর।
সময় পালটে গেছে, ‘ডেঁপোমি’র অর্থের মতোই।