আলাউদ্দিন খাঁ এবং নিখিল ব্যানার্জি : প্রথম আলাপে ইমন রাগ আর বকুনি

শীতটা এখন একটু কম। এমনিতে তফাত কিছুই নেই। মাঘের শীতেও রাতে রেওয়াজ চলতো। খাওয়ার পরে। একটু নির্জনে। এখনো চলে। বাবাই দেখিয়ে দিয়েছেন। দিনে ‘গোশালা’য়। রাতে ঘরেরই এক কোণে। কাউকে বিরক্ত না করে। কিছুতেই বিরক্ত না হয়ে। ভালোই হয়েছে। লাগোয়া ঘরে আশিস বাজাতো। সকালে, বিকেলে, সন্ধেয়। এখন দুজনেই বাজাবে। নির্ভাবনায়। অন্নপূর্ণাদেবী সেদিনই বললেন। যতীনের মনে পড়লো। রেডিওতে বাজিয়ে সে কি ভাব তখন! একদিন সন্ধের মুখে তান কানে এলো। সিঁড়িতেই বসে পড়েছিল যতীন। আর কিছু চাই না। শুধু এই সাধনা! কীসে আসবে এই ছন্দ? বাবা মাঝে মাঝেই গৎ শেখাচ্ছেন। একটা করে। এবার অন্যকিছু চাই। পাল্টা, বোল, কৃন্তন, মীড়, গমক। সময় লাগবে। লাগুক। বাবাকে বলতেই গালভরা হাসি। বললেন, “এতদিনে জ্ঞান হয়েছে। তুমি তো রেডিওতে বাজিয়েছ। ভালোই বাজিয়েছ।” না, রেডিওতে যতীন আর বাজাবে না। বলে এসেছে। লিখে দিয়ে এসেছে। এখন সাধনা। আরও সাধনা। সময়ে। অসময়ে। বাবা প্রায়ই বলেন, “করতে যাও, করতে যাও, করলে পাবেই পাবে।”
মৈহার ডাকঘর থেকে চিঠি নিয়ে আসে যতীন। ফেলেও আসে। উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর নামে। রোজই যায়। হঠাৎ একটা চিঠি এলো। নামটা অচেনা। নিখিল ব্যানার্জি। তেইশে ফেব্রুয়ারি সকালে মৈহার আসছে। এটুকুই লিখেছে। এদিকে ওইদিনই বাবা এলাহাবাদ যাবেন। রেডিওতে বাজাবেন। রবাব আর সুরশৃঙ্গার। বাবা বললেন, “নিখিলের থাকবার জন্য একটা বাড়ি ঠিক করে দাও। আমার বাড়িতে পর্দানশীন, তুমি একমাত্র ব্যতিক্রম।” বাড়ি পাবে কোথায় যতীন? মৈহারে এসে থেকে এ বাড়িতেই। আলাপ হয়নি কারোর সঙ্গেই। যাতায়াত নেই কোথাও। কী করা যায়? চিন্তায় পড়েছে যতীন। এদিকে তেইশ তারিখ এসে হাজির। নিখিলও। এই ঘরেই উঠলো। যতীনের ঘরে রইলো। আপাতত। দেখা যাক কী ব্যবস্থা হয়! নিখিলের মুখেই শুনল যতীন। বহুদিনের চেষ্টা। বাবা রাজি ছিলেন না। বয়স হয়েছে। তাই নতুন ঝক্কি চাননি। এখন চেয়েছেন। তাই নিখিল এসেছে। বাবাকে দাদু বলে নিখিল। মাকে দিদিমা। বাবা প্রশংসা করছেন, “নিখিল খুব সরল ছেলে। পৃথিবীর কিছু জানে না, সংগীত শিখবার জন্য পাগল।”
এদিকে বাবার ট্রেন রাত এগারোটায়। যতীন আজ সন্ধেতেই বসেছে। শেখা হল। সেদিনের মতো। বাবার ওই এক কথা, “তাড়াতাড়ি নিখিলের থাকবার জায়গার কোন ব্যবস্থা করো।” মৈহারে বাড়ির বাইরে একমাত্র পরিচিত গুলগুলজি। স্থানীয় ব্যান্ডের। বাবাই দেখেন। বাচ্চারা আসে। বাজনা শোনে। শেখে। গুলগুলজিই ব্যবস্থা করলেন। একটা মন্দিরে। থাকা-খাওয়ার খরচ লাগবে না। শুধু খাবার জলের কুঁজো এলো। আর লন্ঠন এলো। সঙ্গে কেরোসিন তেল। নিখিলের সন্দেহ হল। ঘর ছেড়ে এই মন্দিরে? বাবা তাকে কিছু বলেননি। পরে বললেন। এলাহাবাদ থেকে ফিরে। পাঁচদিন পরে। শুধোলেন যতীনকে। পরদিন নিখিলের ডাক পড়লো। সকালেই। দেখেই বাবা বললেন, “আজ সকালে এসে পৌঁছেছি। যতীন তো তোমার থাকবার ভালো ব্যবস্থাই করে দিয়েছে।” মাথা নাড়ল নিখিল। সম্মতিসূচক। আরও বললেন বাবা, “কিছু মনে কোরো না, আমার বাড়িতে পর্দানশীন, বাড়িতে কাউকে রেখে শেখাই না। এ যাবৎ যাদের শিখিয়েছি সকলেই নিজের বাসস্থানের ব্যবস্থা করে নিয়েছে। তবে যতীনের কথা আলাদা, ও হলো আমার বুড়ো বয়সের ছেলে এবং প্রাইভেট সেক্রেটারি। আমার কত কাজ করে।…” আরও কত কী বললেন! শেষে নিখিলকে আবার বললেন, “এলাহাবাদে, তোমার সম্বন্ধে মুস্তাক আলি আমাকে অনুরোধ করেছে, তোমাকে না শেখাতে। এককালে যে উস্তাদের কাছে কলকাতায় কয়েকদিন শিক্ষা করেছিলে, সেই উস্তাদ তোমার সম্বন্ধে কেন এই ধরনের কথা বলে? যেহেতু আমি তোমাকে কথা দিয়েছি, তাই তোমাকে শেখাবো। যাই হোক মন দিয়ে বাজাও, নিমকহারামি কোরো না। বেইমানি করলে জানবে আমার কোনই ক্ষতি হবে না। তোমার যেমন ভাব, সেইরকম পাবে। মনে রেখো, ‘দিয়ে ধন, বুঝি মন, কেড়ে নিতে কতক্ষণ?’ আল্লা সবকিছু দিয়ে পরীক্ষা করেন, নীচতা দেখলেই আল্লার জিনিস, আল্লার কাছেই চলে যায়। ঠিক আছে এখন যাও, সন্ধ্যাবেলায় যন্ত্র নিয়ে আসবে।” একনাগাড়ে বলে গেলেন বাবা। এরকমই বলেন। বরাবর।
সন্ধ্যা এলো। নিখিলও এলো। যন্ত্র হাতে। বাবা বললেন, “বাজাও তো।” নিখিল ধরলো। সুর-তাল-লয়। মেরেকেটে দশ মিনিট। তারপরেই প্রলয়। বাবার চিৎকার, “আরে শুয়োর কে বচ্চে, বাজনা হাত দিয়ে বেরোয় না, এখনি উস্তাদি, উস্তাদের মতো মাথা নাড়ানও শিখেছ? বন্ধ করো। রবুর নকল করে বাজাচ্ছ। রবুর নকল করে রবুর মতো বাজালেও সকলে বলবে নকল। রবুর নকল করবে না। তোমাকে অন্যরকম ভাবে শেখাবো।” এরপর কয়েকটা পাল্টা। তারপর মীড়। আবার বাবার শাসন, “ইমন রাগে একসপ্তাহ রিয়াজ করে আমাকে এসে শোনাবে। সামনে আয়না রেখে বাজাবে। মাথা নাড়লে, মাথা ভেঙে দেবো।” শেখাবার সময় বাবা খুব রাগী। বরাবর। পান থেকে চুন খসলেই প্রলয়। নিখিলের রেওয়াজ শুরু হল। চুল উস্কোখুস্কো। গালে না কামানো দাড়ি। মাস দুয়েকের হবে। যতীনের কৌতূহল হল, “দাড়ি কামানোর জিনিস নাই কি? দাড়ি কামাননি কেন?” নিখিলের চোয়াল শক্ত হলো। “যেদিন বাজাতে পারব, সেইদিন দাড়ি কাটব স্থির করেছি।” উত্তর এলো।
তথ্যসূত্রঃ
আলাউদ্দিন খাঁ ও আমরা, প্রথম খণ্ড, পণ্ডিত যতীন ভট্টাচার্য