অনবদ্য অভিনেতা হয়েও বরাবর থেকে গিয়েছেন পার্শ্বচরিত্রে, শতবর্ষে অভিনেতা বঙ্কিম ঘোষ

নেপথ্যের শিল্পী বলেই জানতেন কীভাবে নিজেকে ক্যামেরার ফ্রেমের এক কোণে সরিয়ে রাখতে হয়। তাঁর মৃত্যুর ৩০ বছর পরেও নেপথ্যেই থেকে গিয়েছেন। এমনকি ঠিক কতগুলি চলচ্চিত্রে তাঁকে দেখা গিয়েছে, সেই বিষয়েও সঠিক কোনো তথ্য জানা যায় না। কেউ হিসাব করে দেখিয়েছেন ৫০টি। কারোর মতে কোনোভাবেই ১০০টির বেশি নয়। তবে বাংলা সিনেমার ১০০ বছর পূর্তিতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে যে আর্কাইভ তৈরি করা হয়, তাতে সর্বমোট ১১৫টি ছবির নাম পাওয়া যায় যেগুলিতে অভিনয় করেছিলেন বঙ্কিম ঘোষ (Bankim Ghosh)।
১৯২২ সালে কলকাতায় জন্ম। ওরিয়েন্টাল একাডেমি থেকে প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ করে, ভর্তি হন কলকাতার সিটি কলেজে। শুরু থেকেই মঞ্চের প্রতি অকৃত্রিম টান ছিল বঙ্কিমের। কাজ করেছিলেন ‘আনন্দ ভারতী’, ‘ভারতীয় গণনাট্য সংঘ’, ‘রূপকার’ এবং ‘আনন্দলোক’ সহ বিভিন্ন নাটকের দলের সঙ্গে।
১৯৪৮ সালে ‘ভুলি নাই’ সিনেমা থেকে যে পথচলার শুরু, ১৯৯২ সালে ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘হিরের আংটি’ পর্যন্ত অব্যহত ছিল সেই যাত্রা।
থিয়েটারে ক্যারিয়ার গড়ার ইচ্ছাই একদিন বাড়ি ছাড়তে বাধ্য করে তাঁকে। দিনের পর দিন পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেও হাল ছাড়েননি। অভিনয়ের প্রতি তীব্র ভালোবাসা আঁকড়ে আজীবন বেঁচেছেন। বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসার পর প্রথমদিকে গ্রিন্ডলেস অ্যান্ড কোং, যাদবপুর ইউনিভার্সিটি, ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনস এবং কলকাতা হাইকোর্ট সহ বিভিন্ন জায়গায় চাকরিও করেছেন বেশ কিছু বছর।
অবশেষে ১৯৪৮ সালে বিখ্যাত পরিচালক হেমেন গুপ্তার (Hemen Gupta) হাত ধরে বাংলা চলচ্চিত্রে অভিষেক হয় বঙ্কিম ঘোষের। ছবির নাম ‘ভুলি নাই’। নিতান্তই একটি ছোটো ভূমিকা, তবুও প্রতিবেশী হেমেনবাবুর প্রস্তাব ফিরিয়ে দেননি তিনি। অভিনয়ের যতটুকু সুযোগ পেয়েছেন ততটুকতেই সবটুকু উজাড় করে দিয়েছেন এই অভিনেতা। এর প্রায় এক দশক পর, ১৯৬১ সালে সুশীল ঘোষের ‘দিল্লি থেকে কলকাতা’ চলচ্চিত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পান। এই ছবিতেই দক্ষ অভিনয়ে বঙ্কিম ঘোষ প্রথম নজর কাড়েন পরিচালকমহলে।
'গল্প হলেও সত্যি' চলচ্চিত্রের দৃশ্য
কখনও প্রধান চরিত্রে অভিনয় না করেও দর্শকদের মুগ্ধ করে গিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি থিয়েটারের মঞ্চেও দাপটের সঙ্গে অভিনয় করেছেন বঙ্কিম ঘোষ। ১৯৪৮ সালে ‘ভুলি নাই’ সিনেমা থেকে যে পথচলার শুরু, ১৯৯২ সালে ঋতুপর্ণ ঘোষের (Rituporno Ghosh) ‘হিরের আংটি’ পর্যন্ত অব্যহত ছিল সেই যাত্রা। সত্যজিৎ রায়-এর (Satyajit Ray) সঙ্গে কাজ করেছেন ‘চারুলতা’ এবং ‘চিড়িয়াখানা’ চলচ্চিত্রেও। ১৯৬৬ সালে তপন সিনহার (Tapan Sinha) বিখ্যাত ছবি ‘গল্প হলেও সত্যি’-তে তাঁর অনবদ্য অভিনয়, শরীরী ভঙ্গি আজও দর্শকদের চোখের পলক ফেলতে দেয় না। এই ছবিতে রবি ঘোষ, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো নামজাদা অভিনেতাদের সঙ্গে রীতিমত কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অভিনয় করেছিলেন বঙ্কিমও। এছাড়াও বিজয় বোস, পরিমল ঘোষ, নিরঞ্জন দে-র মতো পরিচালকের সঙ্গে অসংখ্য ছবিতে কাজ করেছেন তিনি। দীর্ঘ ৪৪ বছরের অভিনয় জীবনে সঙ্গত করেছেন উত্তমকুমার, সৌমিত্র, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় সহ অসংখ্য নামকরা অভিনেতাদের। কখনও খলনায়কের ভূমিকায় কখনও আবার কমিক চরিত্রে বরাবর নিজেকে প্রমাণ করেছেন তিনি।
অভিনয়, চলচ্চিত্র এবং থিয়েটারের পাশাপাশি ফুটবল, বক্সিং এবং শরীরচর্চায় গভীরভাবে আগ্রহী ছিলেন। ছোটোবেলায় টানা পাঁচ বছর বেঙ্গল বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপও জিতেছিলেন বঙ্কিম ঘোষ। পরবর্তীকালে শিশু অধিকার নিয়ে একচেটিয়া লড়াই করেছেন তিনি। যুক্ত ছিলেন ‘জাতীয় সংঘ’ নামে একটি শিশু কল্যাণ গোষ্ঠীর সঙ্গে।
‘ভুলি নাই’, ‘দিল্লি থেকে কলকাতা’, ‘চারুলতা’, ‘অতিথি’, ‘জীবন মৃত্যু’, ‘যদি জানতেম’, ‘রাতের রজনীগন্ধা’, ‘চিড়িয়াখানা’, ‘কখনও মেঘ’, ‘চৌরঙ্গী’, ‘গল্প হলেও সত্যি’, ‘কবিতা’, ‘ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিস্টেন্ট’, ‘পরিণীতা’, ‘আলো আমার আলো’, ‘বসন্ত বিলাপ’, ‘ছুটির ফাঁদে’, ‘ঠগিনী’, ‘মেঘ ও রৌদ্র’ ইত্যাদি আরও কতো কতো ছবিতে তাঁর অনবদ্য অভিনয়গুণেই বক্স অফিসে সাড়া ফেলেছে ছবিগুলি অথচ তিনি নিজে থেকে গিয়েছেন আড়ালেই। আজও কোনো লেখালিখি অথবা আলোচনা হয় না এই অনবদ্য অভিনেতাকে নিয়ে।
বাংলা চলচ্চিত্র জগতে যেখানে শতবর্ষ উদযাপন নিয়ে এতো মাতামাতি সেখানে বঙ্কিম ঘোষের মতো দাপুটে অভিনেতার জন্ম শতবর্ষ কেটে যাচ্ছে নীরবেই।