‘হালকা মেঘের পানসে ছায়া তাও দেখছি চেটে’-আবোল তাবোলের খাবার দাবার

মন্ডা ক্লাবের সদস্য ছিলেন সুকুমার। তাই বোধ হয় কথায় কথায় এত খাবার দাবারের কথা। আবোল তাবোলের প্রথম কবিতায় কোনও খাবারের নাম দেখতে পাচ্ছি না। সেখানে শুধু ‘অসম্ভবের ছন্দ চেনাতে আমাদের ভুলের ভবে যাওয়ার ডাক দিয়েছেন সুকুমার। দ্বিতীয় লেখা, ‘খিচুড়ি’। সেখানে পাচ্ছি নেহাতই মিনমিনে কাঁচা লঙ্কার কথা, চিন্তিত গিরগিটির মুখে-
‘টিয়ামুখো গিরগিটি মনে ভারি শঙ্কা-
পোকা ছেড়ে শেষে কিগো খাবে কাঁচা লঙ্কা?’
‘কাঠবুড়ো’ কবিতায় কয়েকটা অসম্ভব খাবারের নাম আমরা পেয়ে যাই।
১) ‘হাঁড়ি নিয়ে দাড়িমুখো কে যেন কে বৃদ্ধ,
রোদে বসে চেটে খায় ভিজে কাঠ সিদ্ধ’।
২) ‘কোন ফুটো খেতে ভাল, কোনটা বা মন্দ,
কোন কোন ফাটলের কি রকম গন্ধ’।
‘ভালরে ভাল’ কবিতায়, দাদা গো দাদা দেখ্ছি ভেবে অনেক দূর, এই কথা বলে সুকুমার লিখলেন, ‘পোলাও ভাল কোর্মা ভাল/ মাছপটলের দোলমা ভাল........খাস্তা লুচি বেলতে ভাল, গিটকিরি গান শুনতে ভাল.....কিন্তু সবার চাইতে ভাল-পাঁউরুটি আর ঝোলা গুড়।
কুমড়ো পটাশে এসে আমরা প্রথম শাকের ঘন্টের নাম পেলাম, তবে তা খাবার হিসেবে নয়, অনেকটা চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশনের মতো-‘(যদি) কুমড়োপটাশ ডাকে-/ সবাই যেন শামলা এঁটে গামলা চড়ে থাকে;/ ছেঁচকি শাকের ঘন্ট বেটে মাথায় মলম মাখে;/শক্ত ইঁটের তপ্ত ঝামা ঘষতে থাকে নাকে। এর পর, গাল ভরা হাসি মুখে চালভাজা মুড়ির কথা পাচ্ছি ‘বুড়ির বাড়ি’ কবিতায়। আর ‘বাবুরাম সাপুড়ে’ তে পেলাম, শুধু দুধ ভাত খায় এমন সাপের কথা। বিষম অবশ্য খাবার নয়, কিন্তু বিষম না খেয়েও তো পারা যায় না। সেই বিষম খাওয়ার কথা এল ‘গোঁফ চুরি’ কবিতায়-“ভীষণ রেগে বিষম খেয়ে দিলেন লিখে খাতায়-/‘কাউকে বেশি লাই দিতে নেই, সবাই চড়ে মাথায়’।”
রোজ রোজ টিফিনের খাবার চুরি হয়ে যায়, সেই ‘চোর ধরা’ কবিতায় চুরি হয়ে যাওয়া খাদ্য তালিকা- ‘পাঁচ খানা কাটলেট লুচি তিন গণ্ডা,/গোটা দুই জিবে গজা, গুটি দুই মণ্ডা,/ আরো কত ছিল পাতে আলুভাজা ঘুঘনি-/ ঘুম থেকে উঠে দেখি পাতখানা শূন্যি!
‘খুড়োর কল’ কবিতায় মেনুটা এরকম-‘সামনে তাহার খাদ্য ঝোলে যার যে রকম রুচি-/মণ্ডা মিঠাই চপ কাটলেট খাজা কিংবা লুচি’। ভাতের কথা প্রথম এল বদ্যি বুড়োকে নিয়ে লাখা কবিতায়- ‘সে নাকি রোজ খাবার সময় হাত দিয়ে ভাত মাখে’।
এবার ‘ছায়াবাজি’-র পুলকিত হওয়অর মতো খাবারের লিস্ট-‘কাগের ছায়া বগের ছায়া দেখছি কত ঘেঁটে-/হালকা মেঘের পানসে ছায়া তাও দেখছি চেটে’। সঙ্গে সুকুমার আরও বলেছেন- ‘বাপরে বলে পালায় ব্যামো ছায়ার ওষুধ খেলে’। এখানেই ছায়ার খাদ্যতালিকা শেষ নয়, এর পর আছে- আমড়া গাছের নোংরা ছায়া কামড়ে খেলে নতুন ঠ্যাং গজাবার কথা, বাদলা দিনে রোগ বালাই থেকে বাঁচতে র খেতে। মৌয়া গাছের মিষ্টি ছায়া সাবান দিয়ে ধুয়ে বিক্রি করা হচ্ছে, এক শিশির দাম মাত্র চোদ্দ আনা। চাটনি আর পোলাও-এর কথা লেখা হয়েছে ‘কি মুস্কিল’ কবিতায়। ‘হুঁকোমুখো হ্যাংলা’ যখন কোন লেজে কোন মাছি মারবে ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছিল না, তার ঠিক আগে হুকোমুখো কী খাচ্ছিল? ‘খাচ্ছিল কাঁচকলা চটকে’। কাঁচকলা থেকে সোজা আকাশ চেটে খাওয়ার গল্প। সীতানাথ বন্দ্যো আকাশের বদনাম করে বলে গেছে, আকাশের গায়ে নাকি টক টক গন্ধ। তার পরের দুটো লাইন-‘টক টক থাকে নাকো হ’লে পরে বৃষ্টি-/ তখন দেখেছি চেটে একেবারে মিষ্ট’। এবার ‘ষষ্ঠিচরন’-এর খাবারের থালার দিকে একটু নজর দেওয়া যাক।
‘সকাল বেলার জলপানি তার তিনটি ধামা পেস্তা মেওয়া,
সঙ্গেতে তার চৌদ্দ হাঁড়ি দৈ কি মালাই মুড়কি দেওয়া।
দুপুর হ’লে খাবার আসে কাতার দিয়ে ডেকচি ভরে,
বরফ দেওয়া উনিশ কুঁজো সরবতে তার তৃষ্ণা হরে।
বিকাল বেলা খায় না কিছু গণ্ডা দশেক মণ্ডা ছাড়া,
সন্ধ্যা হ’লে লাগায় তেড়ে দিস্তা দিস্তা লুচির তাড়া’।
‘সাবধান’ কবিতায় মাছি খাওয়ার কথা আছে। তবে সেটা আনিচ্ছাকৃত- মাছি খেয়ে পাঁচ মাস ভুগেছিল কলেরায়।
মাছি আনিচ্ছায় খেলেও, আমসত্ত্ব কিন্তু ইচ্ছে করেই খান না ‘বোম্বাগড়ের রাজা’। কি করেন? প্রথমে আমসত্ত্ব ভাজা করেন। তেল ছাড়া কি আর ভাজা হব! তেল দিয়েই ভাজেন। তার পর কী করেন? সেই আমসত্ত্বভাজা ছবির ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখেন। বোম্বাগড়ের রাজার যে রানী, তিনি সর্বক্ষণ মাথায় বালিশ বেঁধে ঘরেন। আর তার যে দাদা, তিনি পাঁউুরুটি খান না, পাঁউরুটিতে পেরেক ঠোকেন, কেন কেউ জানে না। আরও অনেক প্রশ্নেরই অবশ্য উত্তর নেই এই কবিতায়। যেমন জানা যায় না, ‘মন্ত্রী কেন কলসী বাজায় ব’সে রাজার কোলে’? যেমন উত্তর নেই রাজার পিসী কেন কুমড়ো দিয়ে ক্রিকেট খেলেন তারও।
পান-এর উল্লেখ একবারই আছে ‘বুঝিয়ে বলা’ কবিতায়। ‘ওরে গোপাল, গোটাকয়েক পান দিতে বল খেঁদিকে’। ঝোলাগুড় কীসে দেয়? বা তেজপাতে তেজ কেন? ঝাল কেন লঙ্কায়? খাবার নিয়ে এই সব কূট প্রশ্ন রয়েছে ‘নোট বই’ কবিতায়। আর ‘হুলোর গান’-এ মালপোয়ার গুণগান করা হয়েছে-‘গালফোলা মুখে তার মালপোয়া ঠাসা/ধুক ক’রে নিভে গেল বুক ভরা আশা’।
আলু খেলে বুদ্ধি গজাবে না, বদ্যিরা কেন আলুভাতে খায় না, এসব কথা বলার পরই ‘ট্যাঁস গরু’ কবিতায় প্রথমেই বলা আছে গরুর খাবি খাওয়ার কথা। তার পর- খায় না সে দানাপানি- ঘাস পাতা বিচালি/ খায় না সে ছোলা ছাতু ময়দা কি পিঠালি;/রুচি নাই আমিষেতে রুচি নাই পায়েসে/সাবানের সুপ আর মোমবাতি খায় সে।/ এক দিন খেয়েছিল ন্যাকড়ার ফালি সে-/তিন মাস আধমরা শুয়েছিল বালিশে।
কাতুকুতু বুড়ো কবিতার শুরুতে কুলপি খাওবার কথা আছে,কিন্তু তার পর যত এগোনো যাবে আসবে ভয়ঙ্কর সব খাবারের নাম। এমনিতে কেষ্টদাসের পিসীর দোকানে কুমড়ো, কচু, হাঁসের ডিম, তিসি এই সব বিক্রি হয়। কিন্তু-‘ডিমগুলো সব লম্বা মতন, কুমড়োগুলো বাঁকা, কচুর গায়ে রঙ বেরঙের আলপনা সব আঁকা।
আবার দেখছি মাছি খাওয়ার কথা ফের আসছে ‘ডানপিটে’ কবিতায়।
‘বাপরে কিডানপিটে চেলে!
শিলনোড়া খেতে চায় দুধভাত ফেলে।
একটার দাঁত নেই, জিভ দিয়ে ঘষে,
এক মনে মোমবাতি দেশলাই চোষে!
আর জন ঘরময় নীল কালি গুলে,
কপ কপ মাছি ধ’রে মুখে দেয় তুলে’!
আবোল তাবোলে আমরা সব মিলিয়ে ৬৩ রকমের খাবারের নাম পাই। তার অনেকগুলোই অবশ্য আবোল তাবোলের মানুষ ছাড়া অন্য কেউ মুখে তুলতে না-ও রাজি হতে পারে। আবোল তাবোলের বর্ণানুক্রমিক খাদ্য তালিকা নীচে দেওয়া হল।
আলু, আলুভাতে, আলু ভাজা, আকাশ চাটা, আমড়া গাছের নোংরা ছায়া, আলপনা আঁকা কচু, আমসত্ত্ব ভাজা
কাঁচা লঙ্কা, কাটলেট, কচু, কুলপি, কুমড়ো, কোর্মা
খিচুড়ি, খাস্তা লুচি, খাজা
চালভাজা মুড়ি, চপ, চাটনি, চটকানো কাঁচকলা
ছোলা ছাতু, ছেঁচকি শাকের ঘন্ট, ছায়ার ওষুধ,
জিবে গজা
ঝাল লঙ্কা, ঝোলাগুড়
দই, দানাপানি, দুধভাত
পান, পাঁউরুটি, পেস্তা, পায়েস, পিঠালি, পোলাও
বাঁকা কুমড়ো, বিচালি
ভাত, ভিজে কাঠ সিদ্ধ
মোমবাতি, মাছি, মাছপটলের দোলমা, মৌয়া গাছের মিষ্টি ছায়া, মিঠাই, মণ্ডা, মালাই, মুড়কি, মালপোয়া, মেওয়া, ময়দা
তেজপাতা, তিসি, তেতুলতলার তপ্ত ছায়া
দেশলাই
ন্যাকড়ার ফালি
লঙ্কা, লম্বা ডিম
শিলনোড়া
সাবানের সুপ, সরবত, সুস্বাদু কাঠের ফুটো
হাঁসের ডিম, হালকা মেঘের পানসে ছায়া