অবনী অনলাইন আছো?

ফেসবুকে ছোট্ট একটা পোস্ট। ‘অবনী অনলাইন আছো?’
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা নিয়ে এই ধরনের রসিকতা প্রথমে ভাল লাগেনি। পরে মনে হল, সত্যিই তো, আজকের ডিজিটাল যুগে কি এই কবিতা লেখা যেত? বা আরও নির্দিষ্ট করে, ‘অবনী বাড়ি আছো’, এই লাইন আজ কোনও কবির পক্ষে লেখা কি সম্ভব? কারণ, দরজায় কড়া নাড়ার আগেই তো মোবাইলে তিন বার দু’জনের মধ্যে কথা হয়ে যেত। শুধু তাই বা কেন? আজ যদি ‘ডাকঘর’ লেখা হত? সেই ডাকঘরের অমল কি তাহলে চিঠির বদলে রাজার হোয়াটসঅ্যাপের জন্য অপেক্ষা করত? সেভ করে রাখত সুধার মোবাইল নম্বর! বা, অমল ভিডিও দেখত স্মার্ট ফোনে!
আমার আর এক বন্ধু অরিন্দমের (নাম বদলানো হয়েছে) বেশ কয়েক জন স্কুল-কলেজের বন্ধু সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। তাঁরা আছেন আমেরিকা, ইংল্যান্ড, চিন, কানাডা, কাতার, লিবিয়া, নাইজেরিয়া-সহ প্রায় গোটা পনেরো দেশে। ফলে এক জন যখন ঘুমোন, অন্য জন তখন আপিস করছেন। তাদের নিজেদের একটা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ আছে। অরিন্দমদের এই গ্রুপে সূর্যাস্ত হয় না। ওরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে, এই হল আমাদের সীমান্তবিহীন হোয়াটসঅ্যাপ দুনিয়া। বলা যায়, অনু-বিশ্বায়ন।
কিন্তু মুর্শিদাবাদে, বাংলাদেশের সীমান্তঘেঁষা গ্রামের ছেলে মুকিবরের (নাম বদলানো হয়েছে) কাছে আবার সীমান্তই রুটি-রুজি। সীমান্তই জীবন। সীমান্তই বিএসএফের বন্দুক। সীমান্তই ভয়। মৃত্যুও ছুঁয়ে থাকে ওই সীমান্তকেই। দিনের শেষে দুটো জিনিস সীমান্তের ওপারে পৌঁছে দিতে না পারলে মুকিবরের পেট চলে না। যদিও মুকিবর যখন দু’টাকা কিলো চালের লাইনে রোদে পুড়ছে, অরিন্দম হয়তো তখন, কোনও ভিসা অফিসের ওয়েটিং রুমে। দু’জনের মধ্যে মিল এই যে দু’জনেই মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন। দু’জনেরই ইন্টারনেট ব্যবহারের সুজোগ রয়েছে। এবং দু’জনেরই একটা করে ভোট। সরকার তৈরির।
১৯ শতকের গোড়ায় স্লোগান উঠেছিল দুনিয়ার মজদুর এক হও। যে ডাক কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো হয়ে, ১৮৬৪ সালে প্রথম কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকেও গৃহীত হল। সেটাই হয়তো ছিল প্রথম বিশ্বায়নের ডাক।
বলা হয়, ‘গ্লোবালাইজেশন’, এই শব্দটা ৭০-এর দশকে তাদের ক্রেডিট কার্ডের পেছনে প্রথম লিখতে শুরু করে ‘আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাংক’ (সূত্রঃমহাশান্তির পরে বিশ্ব-পার্থ চট্টোপাধ্যায়)। আর, কী আশ্চর্য, ওই ৭০-এর দশককেই মুক্তির দশক করার ডাক দিয়েছিলেন চারু মজুমদার। যা নিয়ে মণিভূষণ ভট্টাচার্যের কবিতা- ‘কোথায় বিপ্লব, শুধু মরে গেল অসংখ্য হাভাতে..’।
সমাজতন্ত্রের বিশ্বায়ানের ডাক গত শতকের শেষ দশকেই ম্রিয়মাণ হয়ে যায়। অন্য দিকে ক্রেডিট কার্ডের সেই বিশ্বায়নের ডাকের অশ্বমেধের রথের ঘোড়াকে কেউ এখনও রুখতে পারেনি।
গ্লোবালাইজেশনের ভিতরে অদ্ভুত এক আলো- অন্ধকারে মুকিবর এবং অরিন্দম দুজনেই পথ হাঁটছে। বেলা বেড়ে চলেছে।। আলোও বাড়ছে। কিন্তু অন্ধকার কমছে না!
কোনও ‘আচ্ছে দিন’, কো্নও মুক্তির দশকের ডাকই এই অন্ধকারের সমকক্ষ নয়। মেনে নেওয়াই ভাল, এই অঙ্কটা মেলেনি। এর উত্তর আমাদের জানা নেই।
অথচ, অবনী বাড়ি আছো, এই কবিতা ছাড়া মানুষ বাঁচবে কী করে!