No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    মুর্শিদাবাদের আউল-বাউল

    মুর্শিদাবাদের আউল-বাউল

    Story image

    বাউল ধর্ম
    মুর্শিদাবাদে যে প্রধান লোকধর্ম মানুষের মন কেড়েছে তা হল বাউল-ফকির ধর্ম। হরিহরপাড়া অঞ্চলের তরতিপুর, স্বরূপপুর অঞ্চলে ব্যাপকভাবে জোলা মুসলিম সম্প্রদায়ের বাস। এদের প্রদান পেশা হলো গামছা বোনা অর্থাৎ তাঁত ব্যবসা। এরা মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে অচ্ছুৎ। সাধারণ শিষ্ট মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিয়ে হয় না। এরা সামাজিক ভাবে অত্যাচারিত হয়ে মুক্তিদিশা পেতে অনেকে বাউলধর্ম গ্রহণ করেছে। জিৎপুর, ডোমকলের কুশাবেড়িয়া ইত্যাদি অঞ্চলে শরিয়তি বিধানের শৃঙ্খল ভাঙতে অনেকে বাউল ধর্ম গ্রহণ করেন। স্থানীয় বিত্তশালী মুসলিমরা এদের মেনে নেননি। কুখ্যাত মৌলবি গোলাম মর্তুজার নেতৃত্বে এদের উপর আক্রমণ নেমে আসে। বাউল ফকির সঙ্ঘের সভাপতি, প্রখ্যাত গবেষক ড. শক্তিনাথ ঝা মহাশয় এর প্রতিবাদ করেন এবং অত্যাচার প্রতিহত করতে উদ্যোগী হন।

    ২০১৩ সালে(সম্ভবত) কুশাবেড়িয়ার গ্রামে ফকিরদের উপর অত্যাচার হয়েছিল। অধ্যাপক শক্তিনাথ ঝা আমাকে খোঁজ নেবার জন্য দায়িত্ব দিয়েছিলেন। আমি ক্ষেত্র সমীক্ষার কাজ করেছিলাম। তাতে আমি যা বুঝেছিলাম, তা হল, স্থানীয় শিক্ষিত শিষ্ট মুসলিমদের কথা হল - বাউলদের ঐ মিলনের গান অর্থাৎ কোরান-পুরাণ এক - এসব কথার গান চলবে না। আর ঐ ধূয়াধুনো দেওয়া পছন্দের নয়। যে-কোনও একদিকে যাক। হয় মুসলমান না হলে হিন্দু হোক। তাতে আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু ধর্মের মিলিজুলি মেনে নেওয়া যায় না। বললাম - ধর্মের সমন্বয়ের কথা তো আমরা বলি। উত্তর পেলাম - আলাদা আলাদা সত্তা নিয়ে ঐক্য চাই।

    আউল ধর্ম
    নওদা থানার সবদরনগর, ঝাউবোনা, আলমপুর, গোবিন্দপুর গ্রামে কর্তাভজা সম্প্রদায়ের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে আউল লৌকিক ধর্ম গ্রহণ করেন অনেকে। এঁরা কোনও দেবদেবীকে পূজা করেন না। ডালিমতলায় এঁরা প্রতি সন্ধ্যায় প্রদীপ, ধূপ দেন। প্রতি শুক্রবার সন্ধ্যায় দুলালচাঁদের ভজনা করেন। খাতা পাঠ করেন। পাঠ শেষে বাতাসা বিতরণ হয়। মেয়েরা শাঁখা সিন্দুর পরেন না। গেরুয়া বসন পরেন। স্বজন মারা যাবার পর কোন অশৌচ পালন হয় না। মৃতদেহ দাহও করা হয় না। বাড়ির সংলগ্ন জায়গায় সমাধি দেওয়া হয়। অনেকটা জাত-বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের ক্রিয়াকলাপের মতো। সবদরনগর গ্রামের কানাই মণ্ডল, ত্রিমোহনী গ্রামের গৌরহরি দাস, চণ্ডী কর্মকার ঐ কর্তাভজা সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব দেন। কানাই মণ্ডল মারা গেলে, তার দেহ বাড়ির উঠোনেই সমাহিত করা হয়। তার স্ত্রী কোনও অশৌচ পালন করেননি। দুর্গাপূজা বা অন্যান্য শিষ্ট পূজায় এদের অংশ গ্রহণ করতে দেখিনি। কানাই মণ্ডল মাহিষ্য সম্প্রদায়ের, গৌরহরি মিস্ত্রী সম্প্রদায়ের এবং চণ্ডী কর্মকার সম্প্রদায়ের। এর সবাই অন্ত্যজ সম্প্রদায়ের। এদের উৎসবে কোনও পুরোহিত নিয়োগ করতে দেখিনি। পুরোহিতরা এদের ভালো চোখে দেখতেন না। কানাই মণ্ডলের স্ত্রী এখনও বেঁচে আছেন। অশীতিপর বৃদ্ধা হলেও এখনো তিনি কোনও আচার অনুষ্ঠান মানেন না। প্রায় ব্রাত্য হয়ে একাই থাকেন। শিষ্ট ধর্মাধিপত্যে তিনি প্রায় কোণঠাসা। সবদরনগর গ্রামে ডুবতলায় সুরেন বাবাজি বলে প্রখ্যাত সাধক ছিলেন। ইনি রামায়েত সম্প্রদায়ের। রাম ভজনা করতেন। এঁকে নিয়ে অনেক অলৌকিক গল্প চালু আছে। সুরেন বাবাজি সাধারণ প্রথায় বিয়ে করেননি। তাঁর সেবা করতে আসা এক মহিলাকে ইনি সাধিকা হিসাবে গ্রহণ করেন। ইনিই স্ত্রী হিসাবে গৃহীত হ’ন। সাধারণ মানুষ তাঁকেই মান্যতা দিত। তাঁর গর্ভের সন্তান ‘ফল’ বাবাজি হিসাবে পরিচিত ছিলেন। মাতাজি এবং ‘ফল’ বাবাজি গেরুয়া বসন পড়তেন। এঁরা একদম লোকসমাজের বাইরে জঙ্গলে বাস করতেন। প্রচুর শিষ্য ছিল এঁদের। হিন্দু মুসলিম সব সম্প্রদায়ই একসময় এঁদের কাছে জলপড়া নিতে যেত। মাটিতে গড়াগড়ি দিত অসুখ সারানোর জন্য। এরা রাম ভজনার সাধক হলেও কোনও জাঁকজমক বা ব্রাহ্মণ্য রীতিনীতি এরা মানত না।

    (অরূপ চন্দ্র সম্পাদিত ‘মুর্শিদাবাদ ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে দীপক বিশ্বাসের রচনা থেকে নির্বাচিত অংশ)

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @