No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    আমি নাগরিক পল্লীগীতিকার- কবীর সুমন

    আমি নাগরিক পল্লীগীতিকার- কবীর সুমন

    Story image

    ১১৯২-এর ২৩শে এপ্রিল থেকে ২০১২ এর ২৩শে এপ্রিল। ২০ বছর ধরে পথ হাঁটছে একটা গান, একটা অ্যালবাম। ‘তোমাকে চাই’।  ‘তোমাকে চাই’ অ্যালবাম প্রকাশের ২০ বছর পূর্তিতে মুখোমুখি হয়েছিলাম সরাসরি স্রষ্টার মুখোমুখি

    কবীরদা, একটা গান, একটা অ্যালবাম প্রকাশের ২০ বছর ধরে কথা বলছে সমসময়ের সঙ্গে, আর পালটে দিয়েছে বাংলা গানের ইতিহাস। কেমন লাগছে?

    একটা গান তো নয়, মানে গানের ধারাবহিকতা, ‘তোমাকে চাই’ হল একটি গান, যেটার নামে অ্যালবামটির নামকরণ করা হয়েছিল; না-ও হতে পারত। কারণ আমার প্রস্তাব ছিল, আমি গান লিখে যাব, সুর করে যাব। ওরা বলেছিলেন, এটার ক্যাটিগারি হবে ‘সুমনের গান।’ এই প্রথম একজনের জীবিত অবস্থায় যাকে ওরা বলে ক্যাটালগ প্রোডাক্ট, অর্থাৎ ‘সুমনের গান’ একটা ক্যাটালগ। ‘সুমনের গান এত সাল, সাল ধরা  যাক ১৯৯২-৯৩ সাল’- এই ছিল আমার প্রস্তাব। ওরা বললেন, প্রস্তাবটা ভালো, কিন্তু এর থেকে যদি একটা নাম বেছে নিই। ‘তোমাকে চাই’-টা বেছে নেওয়া হল, সবাই মিলেই বেছে নিলাম। কিন্তু আমার প্রথম ধারণা ছিল ‘সুমনের গান, ১৯৯২-৯৩’ করতে করতে এগোবে।

    কাজেই একটা গান নয়, বলা যায় একটা গানের ধারা বা গানের বা অ্যালবামের ধাক্কা। বাংলা ভাষায় যেহেতু সংগীত-সাহিত্য নেই এবং সংগীত বিষয়টা নিয়ে কী ভাষায় কী ভাবে আলোচনা করব- এ ব্যাপারে আমিও নিশ্চিত নই, অন্যরাও নন। তাই আমরা আলোচনা করতে গেলে গানের সুর, তাল, ছন্দ, গায়কী এগুলো ভাবি না; আমরা প্রথমেই কথার প্রসঙ্গে চলে যাই। তাই যদি সংগীত হিসাবে দেখি তাহলে ‘পাগল’ কিন্তু অনেক বেশি ইন্টারেস্টিং কম্পোজিশন। যাইহোক ‘তোমাকে চাই’ তো থাকেনি আর, থেকেছে যেটা সেটা হল একটা লোকের কাজের ধারাবাহিকতা। ধরা যাক আমি এখনও পর্যন্ত ৮০০-র ওপর গান সুর করেছি, গেয়েছি। রেকর্ডিং হয়েছে ৩০০-র ওপর। আমি একা গাইনি, আমার গান শিল্পীরাও গেয়েছেন। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, হৈমন্তী শুক্লা, সাবিনা ইয়াসমিন, ইন্দ্রাণী সেন গেয়েছেন, ইন্দ্রনীল সেন গেয়েছেন। ছোটরা, নবীনরা গেয়েছেন। শুধু ছোটদের নিয়েই আমার শ্রেষ্ঠ কাজ ‘একসাথে বাঁচবই’।

    তাই আপনি তো আমার সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন না, সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন আধুনিক বাংলা গানের একজন গোলামের, একজন বান্দার। আমি কে? ধরুন আমার জন্মের ঠিক নেই, এত বাবা, এত মা, ‘সে যে প্রাণ পেয়েছে পান করে যুগ-যুগান্তরের স্তন্য’ (গেয়ে শোনালেন)। কাজেই আপনি আমার সঙ্গে কথা বলছেন না, আমি নিতান্তই একজন প্রতিনিধি। বিরাট বিরাট শিল্পী, স্রষ্টা নানান মাপের, সকলেই বিরাট নন, কিন্তু প্রত্যেকে তাঁর মতো কনট্রিবিউট করেছেন। আধুনিক বাংলা গানের একজন গোলাম হিসেবে এটুকু বলতে পারি ‘তোমাকে চাই’ হল একটা বড়ো ধারাবাহিকতার অঙ্গ। কাগজে পড়ছি, লোকে এসএমএস করছেন, কিন্তু আমি আমার কথা ভাবছি না, আমি আমার গুরুদের কথা আমার বাবা-মা-র কথা ভাবছি যারা কেউ আর জগতে নেই। সংগীতাচার্য জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের কথা, অলোকনাথ দে-র কথা। নচিকেতা ঘোষ... এত বড়ো একজন সুরকার পৃথিবীতে খুব কম এসেছেন। আমি বলব, ‘তোমাকে চাই’-এর মধ্য দিয়ে বোধহয় একটা নতুন জায়গা তৈরি হচ্ছে, যেখানে আমরা সচেতন হতে পারি আধুনিক বাংলা গানের বিষয়টায়।

    এটা তো আপনি স্রষ্টার জায়গা থেকে বললেন। কিন্তু একটা প্রজন্মের কান তৈরি হয়ে গেল, বাংলা আধুনিক গান সম্পর্কে একটা নিক্তি তৈরি হয়ে গেল এবং সেই প্রজন্ম ‘তোমাকে চাই’ শোনার পরে তারা কিন্তু তথাকথিত কিছু গানকে বাতিল করে দিল এবং ‘তোমাকে চাই’ এর সঙ্গে বড়ো হতে লাগল। ‘তোমাকে চাই’ বলতে এখানে একটা গানের কথা বলছি না-

    কবীরঃ হ্যাঁ, হ্যাঁ বুঝতে পারছি, বুঝতে পারছি...

    একটা জেনারেশন, আর একটা জেনারেশন তৈরি হচ্ছে। আমি শ্রোতাদের কথা বলছি...

    আজ্ঞে আজ্ঞে

    এই প্রসঙ্গে জানতে চাইব যে, আপনার বিভিন্ন স্টেজ পারফরমেন্সে ‘তোমাকে চাই-এর কথা পালটে পালটে গেছে। শীর্ষেন্দুকে কখনও কখনও ইলিয়াসে রিপ্লেস করেছেন... এই বিষয়টা আপনি কনটিনিউয়াসলি করেছেন, এটা কীভাবে এসেছে?

    এটা খানিকটা বলতে পারেন, আমি অন্তত নিজেকে একজন পল্লীগীতিকার বলেও মনে করি। আমি নাগরিক, কাজেই আমি একজন নাগরিক পল্লীগীতিকার। অন্যের কিংবা আমার যখন মনে হবে গানটা আমার, আমি পালটে দিচ্ছি, ফোকাস এইভাবেই তৈরি হয়। যেমন আমার একটা গানে আছে ‘গান তুমি হও আমার মেয়ের ঘুমিয়ে পড়া মুখ’ (গেয়ে শোনালেন); এই গানটা আমার চেয়ে অনেক বয়ঃকনিষ্ঠ মৌসুমী ভৌমিক  একটি অনুষ্ঠানে গাইছিলেন, উনি কিন্তু ‘আমার ছেলের ঘুমিয়ে পড়া মুখ’ গাইলেন; কারণ ওঁর মেয়ে নেই, ছেলে আছে। আমি এরকমও দেখেছি গানের কথাটা পালটে একজন কবি ‘যাও গান আণবিক বোমাটাকে আনো’ বদলে দিয়ে লিখলেন, ‘যাও কবি আণবিক বোমাটাকে আনো’ একবারের জন্যও তিনি আমার অনুমতি নেননি এবং তিনি সেটা আমার সামনে আবৃত্তি করছেন। আমি কিন্তু এর মধ্য থেকেই নতুন পল্লিগীতির ইডিয়ামের জন্ম দেখছি।

    একদম।

    এখন কেউ যদি মনে করেন অতএব আমি যা ইচ্ছে তাই করব, তা হবে না। যিনি এটা করছেন, তার কিন্তু এটা হক ছিল। পোখরানে তখন বোমা বিস্ফোরণ হয়েছে, কেউ কেউ সাধুবাদ জানাচ্ছেন, আবার প্রগতিশীল মানবতাবাদীরা ধিক্কার জানাচ্ছেন। ফলে যে-কবি এটা করছেন, তিনি খুব সচেতন কবি। তিনি গানকে ছোটো করার জন্য বলছেন না, তিনি কবিকেও ডেকে নিচ্ছেন এই সংগ্রামে। আমায় পিট সিগার বলেছিলেন, তুমি একদিন দেখবে তোমার গানের কথা এদিক-ওদিক হচ্ছে; এবং তুমি হয়তো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছ, বড়োজোর গিটারটা বা তোমার যন্ত্রটা বাজাছ, তুমি আর গাইছ না, অন্যলোকে গাইছে। এইভাবে ফোক সং-এর জন্ম হয়।

    ‘তোমাকে চাই’ অ্যালবামটিতে আরও অনেক গান ছিল। এই গানটা সবথেকে বেশি জনপ্রিয় হল কেন?

    কবীরঃ আমাকে যাদবপুর ইউনিভার্সিটির ফিল্ম স্টাডিজের এক আলোচনা সভায় সঞ্জয়বাবু(মুখোপাধ্যায়) বলেছিলেন, সুমনবাবু, আপনি শেষ কবে বাংলা ছবিতে ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’- কথাটা শুনেছেন? আমি পরে ভেবে দেখলাম কোনো দিন শুনিনি। ওটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ইনিয়ে-বিনিয়ে ‘তুমি বোঝ না আমার কি হয়, তোমার জন্য আমার বুকে তুষের আগুন জ্বলে’ ইত্যাদি। কিন্তু ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি, আমি তোমাকে চাই’- এটা নেই। হয়তো ব্লান্টলি তোমাকে চাই এবং সর্বগ্রাসী সেই চাওয়া, মানুষের রিলেট করতে সুবিধে হল। প্রফেট সুধীন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন, শত ফাল্গুন তোমার অভাবে বিফল হয়েছে অপরিচিতা।’ হায় হায় হায়। হিংসেয় মরে যাই এটা ভাবলে, ওফ এই কথাটা শোনার জন্যই আমি জন্মেছিলাম। এই ‘তোমার তুমিটা এঁকে সুধীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতায় খুঁজেছেন, কবিতার বাইরে খুঁজছেন, তুমিও খুঁজছ, আমিও খুঁজছি। আবার সুকান্ত যখন বলেন ‘অপরের জন্য যুদ্ধ করেছি অনেক, এখন কিন্তু তোমার আমার জন্য’- একবার বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠে। উনি কিন্তু দেশকে বলছেন। আব্র সুভাষ মুখুজ্জের মতো, ‘তুমি আমার মিছিলের সেই মুখ’- আমি আমার লড়াইকে খুঁজে পাচ্ছি আমার প্রেমিকার চোখে। এটাও তুমি। সেটাই যদি না পেলাম, আমার সংগ্রামকে যদি আমার ঈপ্সিতার নয়নে না খুঁজে পাই তাহলে মানুষ হয়ে জন্মালাম কেন? কাজেই তুমিটা একটা সর্বগ্রাসী তুমি হয়ে ছুটেছে। হয়তো সেটা আধুনিক বাঙালির ভালো লেগেছে। 

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @