No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

     আমার পথের পাঁচালি, আমার বিভূতিভূষণ

     আমার পথের পাঁচালি, আমার বিভূতিভূষণ

    Story image

    আজ হঠাৎ ঘুম ভেঙে উঠে দেখি বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি, আকাশের মুখ ভার! অন্যদিন বুঁদ হয়ে যাই, আজ যে অনেক কাজ বাকি! ফিসফিসিয়ে বলছিলাম, "নেবুর পাতায় করমচা, হে বৃষ্টি ধরে যা"।  আজ অবচেতনে বিভূতিভূষণ, 'পথের পাঁচালি',  অপু- দুর্গা! "আজ"ই বা বলছি কেন ? এই স্বপ্নসন্ধানী মানুষটির মায়াকলমের জাদু আমাকে তো সেই কবে থেকেই আচ্ছন্ন করে রেখেছে! 

    কোনো ভাই বোন নেই আমার।  কিন্তু মনে মনে সেই ছোট্টবেলা থেকেই আমি অপুর দিদি, সেই কবে থেকেই... 'পথের  পাঁচালি'রও আগে...যখন "আম আঁটির ভেঁপু" পড়েছি প্রথম।  যখন দক্ষিণ কলকাতার পাট চুকিয়ে আমরা চলে এলাম উত্তর কলকাতায়, ফ্ল্যাটবাড়ির পেছনের বারান্দা দিয়ে রেললাইন দেখা যেত.. ট্রেনের শব্দ পেলেই দৌড়ে যেতাম, আর কামরা গুনতাম ...আমার চোখে নিশ্চিন্দিপুর ছিল, আমার মনে নিশ্চিন্দিপুর!

    বাড়ির মাছ ভাত  খেয়েও ভরপেটে কতবার যে অপু -দুর্গার সঙ্গে একপাতে বসে মনে মনে পাতালকোঁড়ের তরকারী দিয়ে ভাত মেখে খেয়েছি, কিংবা এমনিতে দুধের গেলাস দেখে নাক সিঁটকালেও শেষপাতে অপুর সঙ্গে দু'গাল দুধভাত...., অমন মনে মনেই বিচেকলা খেতে লোভীর মতো হাত পেতেছি ইন্দির ঠাকরুণের কাছে ....পুতুলের বাক্স গুছিয়েছি দুর্গার মতোই পরিপাটি করে, পুতুলমেয়েকে শাড়ি পরিয়েছি ধার করা সেফটিপিন দিয়ে।চোখ বুজলেই দেখতে পেয়েছি চিকচিক করছে ..জঙ্গলের মধ্যে অপুর ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া সোনার সিঁদুরকৌটো।  আমার কাছে প্রেমের প্রথম পাঠ  ছিল নীরেনের প্রতি দুর্গার নিরুচ্চার অনুরাগ।  

    গ্রামবাংলা দেখিনি বড় একটা, কিন্তু একেবারেই যে দেখিনি..তাই বা বলি কী করে ? দেখেছি তো! নিশ্চিন্দিপুর! হীরের নাকছাবি আমায় টানেনি, ওড়কলমিলতার ফুলের নোলক দুলিয়েছি নাকে নির্জন দুপুরে...মনে মনে। হাতে দু'গাছা রঙিন কাচের চুড়ি, কপালে নীলচে সবজ কাচপোকার টিপ। আজও ঘরে চটি পরার অভ্যেস হল না আমার! ধুলোমাখা পায়ে বনেবাদাড়ে দুর্গা ঘুরত যে! মনখারাপের সময়ে স্নান করে যখন চিরুনি চালাই চুলে, মনে পড়ে যায় রুক্ষ এলোমেলো চুলে ঘেরা দুর্গার টুলটুলে মুখ!

    মনে মনে অজস্রবার বিভুতিভূষণকে অনুযোগ করেছি, দুর্গার অকালমৃত্যুর জন্য। কিন্তু এই পরিণত বয়সে এসে ভাবি, ঠিকই তো! ''দুর্গা'দের বয়স বাড়ে না, বাড়তে নেই।  'মৃত্যু' ছাড়া আর কীই  বা ছিল তাকে আমাদের মনে ওইভাবে বাঁচিয়ে রাখার জন্য? কী হত দুর্গার? ওভাবেই বড় হত, হয়ত খেয়েপরে বেঁচে থাকার জন্য ধারদেনা করে বিয়ে হত, দু'চারটে ছেলেপুলেও। তাতে পুনরাবৃত্তি আসত লেখায়, কারণ সেই সর্বজয়ার ছবিটিই আমরা দেখতে পেতাম ঘুরেফিরে, দুর্গার জীবনেও। অপুর ওই অবাক চোখ দিয়ে জগৎ দেখার সুযোগ হত কি ?

    'পথের পাঁচালি' আজও আমায় ঠিক একইভাবে আপ্লুত করে, একইভাবে চোখে জল এনে দেয়। সর্বজয়ার সেই বুকফাটা হাহাকার, "ওগো, হতভাগী যে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে গো"...আর চোখ বুজলেই দেখি হাঁটু পর্যন্ত ধুলোমাখা হরিহরের সেই বাজে পোড়া তালগাছের মতো শীর্ণ শরীর আর অসহায়তা, অপুর মুখের প্রতিটি রেখা ব্যথায় দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে! 

    আমার চেতনে ওই প্রথম মৃত্যু। আর কী আশ্চর্য, এরপর থেকে যে ক'জন প্রিয়জনের মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছি, কোনটিই আর অমনভাবে আমাকে নাড়া দিতে পারেনি!

    দেখেছি 'পথের পাঁচালি' ছায়াছবি। আমি সত্যজিতেরও গুণমুগ্ধ। কিন্তু সত্যজিতের 'অপু' আর বিভুতিভূষণের 'পথের পাঁচালি'। আমি অন্তত সেভাবেই দেখি, সেভাবেই বলি। সেই কিছু গরীব অভাবী মানুষ থাকে না, যাদের আগ্রাসী দারিদ্র্য কিন্তু হৃদয়ের ধন অঢেল? নিশ্চিন্দিপুর আমার কাছে সেই অশেষ বিত্তের স্বাদ এনে দেয়। সেই প্রাচুর্য, সেই বিশালতা, সেই সম্পদ....মাত্র কিছুক্ষণের সাদা কালো ছবিতে সেলুলয়েডের ফ্রেমে ধরে রাখার সাধ্য কার ? 'পথের পাঁচালি' তো আমার কাছে সাদা কালোই নয়..বিরাট মাপের এক ক্যানভাস.. বিভুতিভূষণ তা সাজিয়েছেন রঙের বৈচিত্র্যে আর মাধুরীতে। আমরা তাতে মিশিয়েছি আমাদের কল্পনার হরেকরকম রং..দরাজ হাতে। 

    'পথের পাঁচালি'  ছবি হিসেবে অনবদ্য। প্রথা ভেঙে সম্পূর্ণ অন্য মাত্রায় চলচ্চিত্রমাধ্যমকে উপস্থাপনা...এ আমি এক মুহূর্তের জন্যও অস্বীকার করি না; কিন্তু সত্যজিতের 'পথের পাঁচালি' কেন যেন আমার একান্ত নিজস্ব 'পথের পাঁচালি' হয়ে ওঠেনি।আমার 'পথের পাঁচালি' ওই সাদা পাতায় কালো কালো অক্ষরের সারি..যা চোখ বুজলেই রঙিন ছবি হয়ে যায়।আজও।অবলীলায়।এক নিমেষেই। 

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @