No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    ২৮ বছর আগের এক বিষণ্ণ ফাইনাল

    ২৮ বছর আগের এক বিষণ্ণ ফাইনাল

    Story image

    আজ রাতে বিশ্বকাপ ফাইনাল। যেসব দেশ ও খেলোয়াড়দের ওপর গত কয়েকবছর ধরে বিশ্ব ফুটপ্রেমীদের নজর ছিল, তাঁরা প্রায় সবাই বিদায় নিয়েছে একে একে। পড়ে আছে ক্রোয়েশিয়ার মতো ফুটবল-ঐতিহ্যে অনামা দেশ আর ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স। ১৯৯৮ সালে এই ফ্রান্স দলই ক্রোয়েশিয়াকে হারিয়েছিল সেমিফাইনালে। আজ, কুড়ি বছর পর তারা আবার মুখোমুখি। এবার ফাইনাল।

    সবাই বলছে, এই বিশ্বকাপ অঘটনের বিশ্বকাপ। ২৮ বছর আগে ইতালিতেও কিন্তু এমনই কিছু অঘটন ঘটেছিল খেলার মাঠে। প্রথম ম্যাচে ক্যামেরুনের কাছে আর্জেন্টিনার হার থেকে শুরু করে একে একে তুমুল ফেবারিট হল্যান্ড, ব্রাজিল, ইংল্যান্ড এবং আয়োজক দেশ ইতালির বিদায়। কিন্তু বিশ্বকাপ ফাইনালে সেই মারাদোনা, বাতিস্তা, গায়কোচিয়া-দের সঙ্গে বনাম ব্রেমে ক্লিন্সম্যান, লোথার ম্যাথাইস-দের লড়াই। ৮ জুলাই, ১৯৯০।

    ফাইনালের আগের শেষ এপিসোড সারারাত ধরে এডিট করেছিলাম আমরা। মোটামুটি পুরো বিশ্বকাপে আমাদের ইতালিতে থাকাকালীন যা যা উল্লেখযোগ্য ঘটনা, তারই একটা কোলাজ তৈরি করা হয়েছিল। বেলা নটায় ক্যাসেট বগলদাবা করে, ট্যাক্সি ডেকে আপলোডিং হাবের দিকে ছুটে যাওয়া। স্লট বুক করা থাকত আগে থেকেই। দেরি হওয়ার জো নেই। এপিসোড আপলোড করতে করতে কল্পনা করে নিতাম দর্শকদের প্রতিক্রিয়া। টিভি তখনও এ দেশের বহু মানুষের কাছে স্বপ্নের দুনিয়া। তার ভিতর দিয়ে তারকাদের দেখা, ম্যাচের বাইরে তাঁদের গতিবিধির হদিশ পাওয়া। এই অনুষ্ঠান প্রবল জনপ্রিয় হয়েছিল। আর, আমরা যারা ক্যামেরার এপার থেকে এইসব ফুটেজের সত্যিকারের সাক্ষী? আগেই বলেছি, ফুটবলের একেকজন স্বপ্নের তারকাদের চাক্ষুষ দেখার যে অভিজ্ঞতা, তা লিখে বোঝানো সম্ভব নয়।

    ফাইনালের আগের দিন, বিশ্বকাপ কভার করতে যাওয়ার সারা পৃথিবীর বেশ কয়েকজন বাছাই সাংবাদিককে নৈশভোজের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ইতালির মেয়র। আমরাও আমন্ত্রিত হয়ে পৌঁছেছিলাম সেখানে। উপস্থিত ছিল বিশ্বকাপের ফাইনালিস্ট দুই দলের সদস্যরাও। সে এক এলাহি আয়োজন। রেড ওয়াইন আর লিকুয়রের ফোয়ারা ছুটছে চারপাশে। সাহেবরাও বেহিসাবি হয়ে যে কী পরিমাণ মাতলামি করতে পারে – ওই পার্টিতে না গেলে বুঝতাম না আমরা। অবশ্য কমবেশি সবার মুখে একটাই আলোচনা– কাল ফাইনালে কে জিতবে। ব্যক্তি হিসেবে মারাদোনার স্তুতি সর্বত্র। মারাদোনা কি জাদু দেখাতে পারবেন কাল? উঠে আসছে পশ্চিম জার্মানির টিমগেমের কথাও।

    ফাইনালের দিন আরেক চমক। আপলিঙ্কিং করে বেরিয়ে আসার সময়, রাস্তায় মুখোমুখি হলাম ব্রাজিলের কিংবদন্তি সক্রেটিসের সঙ্গে। অমন এক অসামান্য ফুটবল-ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি রোমের রাস্তায়! প্রথমটায় থতমত খেয়ে গিয়েছিলাম দেখে। পরে যখন বুঝলাম, ইনি পৃথিবীর সেই বিখ্যাত ফুটবল প্লেয়ার সক্রেটিস – তখন মাথায় দুটো বিষয় কাজ করছিল। এক, আমার যা উচ্চতা, তা নিয়ে ওঁর পাশে গিয়ে দাঁড়ানো যাবে না। দুই, কী বলব, কী প্রশ্ন করব আর কেনই বা করব? এসব ভাবতে ভাবতে কিছুক্ষণের জন্য তলিয়ে গেছিলাম। সম্বিত ফিরে আসতে, মোহান্তিকে বললাম– পাশে গিয়ে দাঁড়াও, ছবি তুলি। মনে আছে, পাশের একটা বেঞ্চে পাঁচ-দশ মিনিটের জন্য বসেছিলেন আমাদের সঙ্গে। খুবই ভাঙা-ভাঙা ইংরেজিতে ভারত সম্বন্ধে কিছু কৌতূহল প্রকাশ করলেন। তারপর, মনে হল ব্রাজিলেরই কোনো সাংবাদিকের সঙ্গে চোখাচুখি হওয়াতে উঠে চলে গেলেন। আমার আর মোহান্তির তখন যে কী অবস্থা, তা আমরাই জানি। শুধু, সারারাত কাজ করার পর, অভিজিৎ আর ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে বেরোতে পারেনি। সেই দুঃখ আজও ভুলতে পারিনি।

    সারা রোম জুড়ে সেদিন শুধু আর্জেন্টিনা আর জার্মানির সমর্থকদের ভিড়। নাচ-গান-শ্লোগান ইত্যাদিতে রাস্তাঘাট প্রায় বন্ধ হওয়ার জোগাড়। ইতালিয়ানদেরও দেখছিলাম, নাপোলিতে মারাদোনার খেলার সুবাদে, নিজেদের হার ভুলে গিয়ে আর্জেন্টিনাকে সমর্থন করছিল। তারপর অবশ্য ম্যাচ শেষে দাঙ্গাও দেখেছি চোখের সামনে। দুই যুযুধান পক্ষের মাঝখানে আটকে পড়ে কাটাতে হয়েছিল বেশ কিছুক্ষণ। আজ মেলা ভাঙার বিষাদ। ফাইনাল হয়ে যাওয়ার পর, সারা পৃথিবীর যত মানুষের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হয়েছে এখানে, তাঁদের থেকে বিদায় নেওয়ার পালা। ফিফা এবং ইতালির ফুটবল ফেডারেশনের কর্মকর্তারা এই বিশ্বকাপ আয়োজনের বিপুল সাফল্যে খুশি। ফাইনাল দেখতে ফিফার প্রেসিডেন্ট জো হাভালাঞ্জ রোমে উপস্থিত, সঙ্গে ফিফার তৎকালীন সেক্রেটারি শেপ ব্লাটার। মাঠের আশেপাশে নিরাপত্তা আরও জোরদার। সাংবাদিক এবং চিত্রসাংবাদিকদের জন্যেও সেই নিয়মের কড়াকড়ি। নিয়ম মেনে কাজ না করলেই তার খেসারত দিতে হচ্ছে বহু সাংবাদিককে। এমনকি, ফাইনালের দিনে কলকাতা থেকে যাওয়া একটি দৈনিক পত্রিকার বাঙালি চিত্রগ্রাহককেও ভুগতে হয়েছিল। ফাইনাল ম্যাচের জন্য ফিফার নিয়মাবলি ও রক্ষণরেখা ছিল একটু ভিন্ন। এতদিন ধরে যে অ্যাকসেস আমাদের দেওয়া হত, তা একদিনের জন্যে একটু কমানো হয়েছিল। কিন্তু সেই বাঙালি চিত্রগ্রাহক অতি-উৎসাহে সেটা লঙ্ঘন করাতেই, চোখের সামনে দেখলাম - পাঁজাকোলা করে একদম স্টেডিয়াম থেকে বের করে দেওয়া হল তাঁকে। চেনামুখ, কিন্তু অচেনা এই ‘বিপ্লবের’ খেসারত তাঁকে হাতেনাতে দিতে হল।

    যাইহোক, বিশ্বকাপ শেষ হল। ব্রেমের গোলে জিতেছিল জার্মানি। চারপাশে আর্জেন্টিনার সমর্থকদের বিষণ্ণতা। পরদিন, ৯ তারিখ আমি ও আমার স্ত্রী লন্ডনের উদ্দেশ্যে প্লেন ধরলাম। বাকিরা দোহা হয়ে কলকাতায়। বিবিসি বাংলা বিভাগ থেকে আমার সাক্ষাৎকার নিতে চাইল। বিশ্বকাপ কভার করার অভিজ্ঞতা জানতে চায় তাঁরা। বিবিসি হাউসে গিয়ে সেই সাক্ষাৎকার দিয়েছিলাম ১০ জুলাই। বেরোবার সময়, একজন পেছন থেকে ডেকে বললেন, “ক্যান ইউ প্লিজ কনট্যাক্ট দ্য অ্যাকাউন্ট’স অফিস?” আরেক চমক। দুটো দশ পাউন্ডের নোট দিয়ে একটা ভাউচারে সই করিয়ে দিল আমাকে। অভিজ্ঞতা বলার পুরস্কার।

    আজ, ২৮ বছর পর, সেই স্মৃতিগুলো (যদিও অনেককিছুই আজ আর মনে নেই) যখন একে একে মাথায় আসছিল, আর লেখার এই সুযোগ যখন পাওয়াই গেল, ছাড়তে চাইলাম না। এও তো এক অধ্যায়... বাংলার সঙ্গে বিশ্বের যোগসূত্র। মাধ্যম হয়ে রইল ফুটবল বিশ্বকাপ...

    Tags:

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @