এক লালমুখো বাঙালি পাদ্রীর গপ্পো

“স্থান: ডালহৌসি থেকে কালীঘাট, চলন্ত ট্রামের বেনামী ভিড়ের মধ্যে। কাল: বিশ্রম্ভালাপের কাল, অর্থাৎ সন্ধ্যাবেলা। কুশীলব: আমার ঝুলন্ত প্রতিবেশী ও ঝুলন্ত আমি।
প্রতিবেশি: আপনার দেশ কোথায়?
আমি পঞ্চশত একাশীতিতম বারের মতন উত্তর দিলাম: বাংলা দেশ।” (ডায়েরির ছেঁড়াপাতা)
সে মাত্র কিছুকাল আগের কথা। এদেশে ব্রিটিশ সায়েবসুবোদের ছড়ি ঘোরানোর দিন তখন সবেমাত্র ফুরিয়েছে। সেই যারা বাঙালিদের কালা আদমি ব’লে হ্যাটা করত! ৪৭’-এর আগস্টের কিছু আগে-পরে জাহাজ ভর্তি করে এঁদের অধিকাংশই ফেরত চলে যান। আর এর বছরখানেকের মধ্যেই জাহাজে করে কলকাতা শহরে এসে পৌঁছন আরেকজন ভিনদেশি। ব্রিটিশ নন ইনি, এঁর দেশ বেলজিয়াম। পল দ্যতিয়েন। খ্রিষ্টসন্ন্যাসী । ধর্ম-সংক্রান্ত কাজকর্মের জন্যই মূলত আসা এদেশে। ১৯৭৭ পর্যন্ত একটানা ছিলেন এখানেই। কলকাতা-শান্তিনিকেতন-বাসন্তী-শ্রীরামপুর ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে বাংলা ভাষা মনের মতন করে আয়ত্ব করতে সময় নেন মোটামুটি দশ বছর। তবে তার মধ্যেই দ্যতিয়েন সেই বাঙালি হয়ে উঠেছিলেন, খুব অল্প সময়েই যিনি উপল্লব্ধি করে ফেলেন এক সারসত্য- “বাঙালিরা শুধু মনে-প্রাণে নয়, উদরেও ভালবাসে।”
লালমুখো এই পাদ্রিসাহেব কথা বলতেন বাংলায়, খেতেন ঘুগনি-পেঁয়াজি, ব্যবহার করতেন লুঙ্গি-গামছা, শুনতেন রবীন্দ্রসঙ্গীত, কলকাতায় এলে থাকতেন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের কাছেপিঠে কোথাও। বিচিত্র এও, ইনি লিখতেন বাংলা ভাষায়, বাংলা গদ্য। অবশ্যই প্রশ্ন উঠতে পারে, সেই কত বছর আগে উইলিয়াম কেরি, মার্শম্যানরা তো দিব্যি বাংলা ভাষা-বাংলা গদ্য নিয়ে কাজকর্ম করেছেন, দ্যতিয়েন তাহলে বিচিত্র কীভাবে! নানান ভিনদেশি বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি নিয়ে বহুরকম চর্চা করেছেন, ঠিকই। কিন্তু বাংলা ভাষায় মৌলিক রম্য-গদ্য রচনা কেউ করেছেন কি? বোধহয় না। অবশ্য কেরি-মার্শম্যানদের নিজেদেরই তো বাংলা গদ্যের কাঠামো তৈরি করে নিতে হয়েছিল, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শতাব্দী-সমৃদ্ধ ইতিহাস তাঁরা চর্চা করতে পারেননি। কিন্তু এঁরা কেউই কি দ্যতিয়েনের মতন করে মননে ও বয়ানে বাংলা ভাষা তথা সংস্কৃতি সম্পর্কে উত্তম পুরুষের ব্যবহার করতে পেরেছিলেন অক্লেশে? না। ভোলা উচিত নয়, বিদেশি পল দ্যতিয়েন ছিলেন সেই বাঙালি যিনি সনির্বন্ধ অনুরোধ করে গিয়েছিলেন তাঁর শ্রাদ্ধবাসরে রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনাতে।
দ্যতিয়েন টানা প্রায় তিন দশক বাঙালিকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন। রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ আত্মস্থ করেছেন ভালোবেসে। বাংলা ভাষার নিজস্ব সব আটপৌরে প্রয়োগকে সাজিয়ে নিয়েছেন লেখায়। তাই, তাঁর গদ্যে ঢুঁ মারলেই মিলবে ‘হাঁসের ডিমের মতন বড় বড় চোখ’-এর উল্লেখ ও আরও কত কী। তাঁর সব লেখাতেই নিজের উপলব্ধির কথা থাকলেও সমস্তটা আসলে সেই বাংলা ও বাঙালি নিয়েই চিন্তাভাবনার ফসল। আর শুধু তো সাহিত্য নয়, এখানকার সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতি এমনকি বাংলা সিনেমার খুঁটিনাটির দিকেও নজর দিতে ভোলেননি ফাদার দ্যতিয়েন। “কিছু বোম্বাই মার্কার নকল মাল আর গুটিকতক পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক ছবি বাদ দিলে দেখা যাবে, তিনটি পটভূমি ফিরে ফিরে আসে বাংলা ছবিতে। ঠাসা, ঘিঞ্জি, অতি-অধ্যুষিত ফ্ল্যাট-বোঝাই কলকাতা, গ্রামের উঠোন ঘিরে গ্রামীণ পরিবার-জীবন আর এক-শতক দেড়-শতক আগের উচ্চ মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়”। একটুখানি মনে রাখা ভালো, বাংলা সিনেমা নিয়ে তাঁর এই উপলব্ধি সেই সময়কার, যখন আমাদের সাদা-কালো সেলুলয়েডের যুগ ফুরোয়নি।
সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়াতেন। উত্তর কলকাতার তেলিপাড়া লেন থেকে পাঞ্জাবি আর ঢোলা পায়জামা পরে ঘুরে বেড়াতেন সাইকেলে। ১৯৫১ সালে সেন্ট জেভিয়ার্সের রেক্টর ফাদার হেনরি বারকে অনুরোধ করেছিলেন তাঁকে কোনও গ্রামে পাঠাতে। যাতে ঝরঝরে মুখের বাংলা আয়ত্ত করতে পারেন। সুন্দরবনের নানা গ্রামে এরপর ঘুরে বেড়িয়েছেন দ্যতিয়েন। বাংলাভাষাকে শিকড় থেকে চিনেছেন। লিখতে শুরুও করেছেন। ১৯৫৯-এই প্রকাশ পাচ্ছে তাঁর ‘ডায়েরির ছেঁড়া পাতা’। কে বলবে এই লেখার লেখক একজন সাহেব।
আরও পড়ুন
‘রাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড, হিন্দু ট্রাভেলার’
নেহাত বাংলা লেখা নয়, বাংলা পত্রিকা সম্পাদনাও করেছিলেন ভিনদেশি বাঙালি এই মানুষটি। হিন্দি শিখতে শিখতে মাঝপথে ছেড়ে দেন- পাছে বাংলা ভাষা থেকে দূরে চলে যেতে হয়, এই ভয়ে। অথচ ১৯৭৭-এর পর আবার প্রায় তিন দশক দ্যতিয়েন কাটিয়েছেন বিদেশে। আদতে জন্মভূমি হলেও, সে তখন তাঁর কাছে প্রবাসের সমান। এতদিন বাংলা থেকে দূরে থাকলে বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির খুঁটিনাটি ভুলে যাবারই কথা, স্বাভাবিকও তা। বিশেষ করে, যখন জন্মসূত্রে বাঙালি নন দ্যতিয়েন। অথচ ২০০৫-এ ‘দেশ’ পত্রিকায় ফের যখন বাংলা লেখালিখি শুরু হল (‘আটপৌরে দিনপঞ্জি’ এবং ‘সাদাসিধে খসড়া’), সাবলীলতায় এতটুকু চ্যুতি পাননি আজকের পাঠক। বরং এর পরবর্তী বছরগুলোয় মৃত্যুর আগে পর্যন্ত একাধিক বার এদেশে এসে একুশ শতকের বাংলা সংস্কৃতি সম্পর্কে দ্যতিয়েন বলে গিয়েছিলেন- আজকের বাঙালির বাংলার অধঃপতন ঘটছে।
নিজের সম্পর্কে দ্যতিয়েন বলতেন “নামে যবন, জাতে ম্লেচ্ছ”। বাঙালির মনের গোঁড়া ধাঁচটুকু তাঁকে যে সেভাবেই দেখেছে তা তিনি প্রথম থেকেই জানতেন। বিয়েবাড়িতে সম্ভ্রান্ত মানুষের সঙ্গে না বসিয়ে দূরে বাড়ীর মেথরের সঙ্গে খাবার জায়গা দেওয়া, তাঁকে উপনয়নের নিমন্ত্রণ করেও তা প্রত্যাহার করে ফেলা- এমন অনেকগুলি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হয়েওছিল তাঁর। ভাবলে আশ্চর্য হতে হয় বাংলাদেশের গদ্যদেবতাকে তবুও এই সন্ন্যাসী নিঃসংকোচে বলে গেছেন- “তোমার মতন এমন টানে কেউ তো টানে না”। এ কেবল মুখের কথাই নয়, শুরুতেই তাঁর যে কথোপকথনের উল্লেখ করা আছে- দ্যতিয়েন নিজেও উপলব্ধি করেছেন তা-ই; তিনি আদতে বাঙালিই, তাঁর দেশ – বাংলাদেশ।
পাঠক ভাবতেই পারেন, দ্যতিয়েনের কথা আজ হঠাৎ এভাবে উজিয়ে তোলার অর্থ কী? না, কোনও বিশেষ দিনক্ষণের গপ্পো এর আড়ালে নেই। আসলে, ক্ষমতার অলিন্দে ঢুকতে পারা, শাসকের চাপ, অর্থনৈতিক সুবিধের প্রয়োজন ছাড়া ভিনদেশি ভাষা খুব কি কেউ শেখে! তাও আবার তৃতীয় বিশ্বের এই ছাপোষা বঙ্গদেশের ভাষা। ধর্মপ্রচারের দায়ে স্থানীয় ভাষা শেখার স্বার্থ থাকে বটে, কিন্তু সেই ভাষায় টানা লিখেই চলা! শুধু সেই ভাষা নয়, বাংলার সংস্কৃতিকেও নিজের করে নেওয়া! আজ যখন খোদ বাংলার ভূমিসন্তানদেরই ভাষা-সংস্কৃতি থেকে পা উঠছে, তখন দ্যতিয়েনরা এক বিস্ময়ের ঘোর তৈরি করেন আমাদের সামনে। কীসের টানে এই ভাষাকে এত ভালোবাসলেন দ্যতিয়েন? নিজেকে সেই বেড়ায় জড়িয়ে নিলেন উঠোনের কলমিলতাটির মতো? গায়ের চামড়া লালচে সাদা, সাহেব, পাদ্রী সত্ত্বেও দ্যতিয়েন কি আমাদের প্রজন্মের অনেকের চাইতেও বেশি বাঙালি নন? ভাষা কি শুধুই জন্মসূত্রে পাওয়া অধিকারের বিষয়? দ্যতিয়েনরা সেই চিরাচরিত সত্যে প্রশ্ন তুলে দিয়ে যান অনায়াসে।