No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    জার্মানির চিঠি ২ : বিল্ড-এর বিল বনাম ম্যাটারহর্নের মার্কেটিং

    জার্মানির চিঠি ২ : বিল্ড-এর বিল বনাম ম্যাটারহর্নের মার্কেটিং

    Story image

    ঠিক এপ্রিলের মাঝামাঝি আসে। বাগানের এই অতিথি এবারও পয়লা বৈশাখে হাজির হল। থোকা থোকা ফিকে বেগনি ছেয়ে গেছে মগডালে। রোজ বাজার করতে যাওয়ার পথেও তাদের সারি দেখি। প্রকৃতির লকডাউন হয়নি, তাই ট্রামলাইনের ধারে, স্টেশনের পাশে, পথেঘাটে যত্রতত্র পসরা এই ক্ষণকালের অতিথির। এক সপ্তাহ পর থেকে হালকা বাতাসে উড়তে উড়তে চাদর হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে জমা হবে ঘাসের ওপর। মাসের শেষে উধাও। দ্যাখা পাওয়া যাবে আবার সেই এক বছর পর।

    জাপানের একচেটিয়া নয়, চেরীব্লসম এদেশেও আছে বৈকি।

    চেরীব্লসম আর বাংলা নববর্ষ দুইয়ে মিলে যখন কিঞ্চিৎ বাহিরমুখী মন, তখনই আঙ্গেলা মার্কেল একটি ম্যারাথন দিনশেষে অবশেষে ঘোষণা করলেন লকডাউন শিথিল হচ্ছে। ছোট দোকানপাট ইতিমধ্যে খুলছে। স্কুল খুলছে ৪ মে। চার্চ এবং সমস্ত ধর্মীয় ভিড় এখনও নিষিদ্ধ। বর্ডার বন্ধ আরও কুড়িদিন। তালাবন্ধ করে ছুটিতে পাঠানো অর্থনৈতিক পরিকাঠামোকে একটু একটু করে চালু করা হবে। পরিস্থিতি পুনর্বিবেচনা করে বাকি সিদ্ধান্ত আবার দুসপ্তাহ পরে। মোটের ওপর, শেষ হয়েও হইল না শেষ।

    যাদের কাছে জার্মানি মানে হিটলারের ইতিহাস, দ্য গ্রেট ডিক্টেটর নামক একটি ছবি আর শুধু বায়ার্ন মিউনিখ নামক একটি দল, তাদের কাছে জার্মানির আজকের রাজনৈতিক সমীকরণটা পরিষ্কার হওয়া দরকার। কেন্দ্রে একটি কোয়ালিশন সরকার বহুবছর কার্যশীল, যার পোশাকি নাম 'মার্কেল 4.0n' ধরা যেতে পারে। প্রতি চার বছর ক্রিস্টিয়ান ডেমোক্র্যাট, সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট আর ক্রিস্টিয়ান সোশ্যাল ইউনিয়নের এই সমীকরণ নতুন করে সঙ্কটের মুখে পড়ে। তিনটি পার্টির এই গ্রোকো (গ্রোসে-কোয়ালিতসিওন কিংবা মহাজোট) নিয়েই মার্কেল পনেরো বছর রাজ করছেন। যারা ভাবেন জার্মানি তথা ইউরোপের মহামুখ বলতে মার্কেল-ই বিরাজমান, তাঁরা ঘুণাক্ষরেও টের পাবেন না ছেষট্টি বছরের চ্যান্সেলরের চেয়ার নড়াতে পনেরোজনের ক্যাবিনেটে নয়জনই তাঁর বিপরীত পার্টির। আসলে, হয়ত হিটলার নামক এক একছত্র অধিপতির ফল ভুগে আজ বহুবছর জার্মানরা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে কোন দলকে জেতায়নি। এদের সাথে যোগ করুন ষোলটি রাজ্যের শাসকদের। ক্ষমতার নিরিখে যাদের মিনিস্টার-প্রেসিডেন্ট পদবীটা খুবই সমীচীন। লকডাউন খুলবে কি না, খুললেও কতটুকু উচিৎ - সমস্তকিছু নির্ভর এই অঙ্গরাজদের অভিপ্রায় এবং স্বার্থের ওপর। তাদের নিয়েই দীর্ঘ আলোচনা পয়লা বৈশাখ থেকে শুরু করে পরের দিন অব্ধি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভিডিও কনফেরেন্স গড়ানোর পর এই ঘোষণার চূড়ান্ত আকার স্থির হল। এ যেন হিমশীতল জলের দাবি করে নাতিশীতোষ্ণ অম্বুপ্রাপ্তি, তাই লকডাউন শিথিলতার ঘোষণা সামগ্রিকভাবে সমালোচিত হলেও সাবধানী মার্কেল একটি বাক্যেই বহুকথা বলে দিয়েছেন - একটি ভঙ্গুর সাফল্যের ওপর দাঁড়িয়ে জার্মানি।    

    ইন্‌সার নাম শুনেছেন? ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাকাডেমি (ইন্‌সা)। যার জার্মান দোসরের নাম লিওপল্ডিনা। রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে  অবিভক্ত জার্মানিতে যার সৃষ্টি, লকডাউনের উপদেশ নিতে ইস্টারের ছুটির আগে যাদের কাছে মার্কেল রিপোর্ট চেয়ে পাঠান। এই রিপোর্টের ভিত্তিতেই আগামী দিনে জার্মানি ধীরে ধীরে কি করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাবে তার বিস্তারিত সুপারিশ করেন লিওপল্ডিনার সমাজবিজ্ঞানী, জীববিজ্ঞানী এবং বিভিন্ন পেশার গবেষকের এক দল। ম্যাড়ম্যাড়ে এই নিয়ন্ত্রিত শিথিলতা ঘোষণার মূলে ছিল এই রিপোর্ট - যা দলমত নির্বিশেষে গ্রাহ্য করা হয় চূড়ান্ত রূপায়নে। আর, ইন্‌সা নামক সংস্থাটি করোনাকবলে পড়া ভারতবর্ষকে পার করতে সরকারের কতটা কাজে আসছে ?  কিংবা উলটো করে বলা ভাল – কেন্দ্রীয় সরকার কতটা উপদেশ নিচ্ছে ইন্‌সার ? গুপ্তচর কিংবা স্টিং রিপোর্টার না লাগিয়েও নিঃসন্দেহে বলতে পারি, সন্ধ্যে আটটায় টিভিতে আবির্ভূত হয়ে চারঘন্টা পরই ১৩৫ কোটিকে শক অ্যান্ড অ ট্রিটমেন্ট দেওয়াতে অভ্যস্ত কেউ - কোনভাবেই এহেন জাতীয় প্রতিষ্ঠানের উপদেশ চাইবেন, এটা ভাবাই বাতুলতা।  অথচ, ইন্‌সা এবং লিওপল্ডিনার আছে এক নিবিড় যোগাযোগ, ২৫% বিদেশী মেম্বারের একজন - নাইসেডের পূর্বতন কর্তা।

    এরই মাঝে বোমা ফাটিয়েছে বিল্ড নামক জার্মানির সর্বাধিক প্রচারিত ট্যাব্লয়ডটি। করোনার জন্য দেশের হয়ে সরাসরি চীনকে ক্ষতিপূরণ দাবী করেছে দেড়শ বিলিয়ান ইউরো, ভারতীয় মুদ্রায় যা প্রায় বারশো হাজার কোটি টাকা। রীতিমত অঙ্ক করে ক্ষতির হিসেবও দেওয়া হয়েছে কোন খাতে কত। পর্যটনে দুশো ষোলহাজার কোটি, লুফৎহান্সার খাতায় ঘণ্টাপিছু আট কোটি এবং সরকারি বেকারভাতাসদৃশ খাতে চারশ হাজার কোটি। বিল্ডের দাবীকে স্বীকৃতি দেওয়ার মত কেউ মুখ না খুললেও  তাদের এমন একটা অনুগত পাঠককূল আছে যে চীনা দূতাবাসকে এই খবর গ্রাহ্য করে জেনোফোবিয়ার সেন্টিমেন্ট দিয়ে স্টেটমেন্ট দিতে হয়েছে। তবে, ক্ষতিপূরণ কিংবা জিডিপি-র হ্রাস ত পরের কথা, জার্মান অর্থনীতির শিরদাঁড়া যে অটোশিল্প তারা ত স্বেচ্ছায় বন্ধ হয়ে বসে আছে। যার ফলে প্রত্যক্ষ/পরোক্ষভাবে জড়িত দেড় মিলিয়ান কর্মীর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। বন্ধ ফ্যাক্টরি কেবল লকডাউন হটিয়ে চালু সম্ভব নয়, কাঁচামাল চাই চীন থেকে, অনুসারী শিল্পের যোগান চাই ইটালি আর স্পেন থেকে, সর্বোপরি ডিলারস্টক ক্লিয়ার করা চাই সমগ্র ইউরোপে। তারই প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে লকডাউন শিথিলতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটা হয়ত ডিলার শোরুম খুলতে দেওয়ার বিশেষ ছাড়।

    দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নাকি এমন সংকট আর আসেনি, মার্কেল সর্বপ্রথম একথা বলার পর অনেক দেশনেতার মুখেই একই কথা শোনা গেছে। ১৯৪৫-র সেই যুদ্ধশেষের এবছরই পঁচাত্তর বর্ষপূর্তি। সমাপ্তির সেই ইতিহাসের পাতায় এপ্রিলের এই শেষ দশটি দিন হয়ত বা সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ। বার্লিন অবরুদ্ধ, রেড আর্মির তোপ পৌঁছে যাচ্ছে রাইখ চান্সেলরীর আশেপাশে। ব্রান্ডেনবার্গার গেটের ঢিলছোঁড়া দূরত্বে ফুয়েরারবাঙ্কারে হিটলার তখনো ম্যাপের ওপর নিমগ্ন। কোন এক দৈব হস্তক্ষেপে পিছু হটবে শত্রু, যুদ্ধ ঘুরে যাবে নাৎসিবাহিনীর পক্ষে। ভ্রান্তবিশ্বাসের এই হঠকারীতার স্থায়িত্ব আর কয়েকটা মাত্র দিন। ২০ এপ্রিল হিটলারইয়ুথকে সম্বর্ধনা দিতে শেষবারের মত বাঙ্কারের বাইরে আসা এডলফ্‌ হিটলারের। শেষ জন্মদিনে। তারপর একে একে ঘটনার সমাপতন। গোরিং এর কৌশল, বন্ধু মুসোলিনির হত্যা, হিম্‌লারের পলায়ন, ভ্রাতৃপ্রতিম অ্যালবার্ট স্পীরের স্বীকারোক্তি এবং সবশেষে উইল এবং ইভা ব্রাউনকে বিয়ে করেই আত্মহত্যা। পঁচাত্তর বছর আগের শেষ বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে আজকের একটা ফারাক। এই জার্মানি এই যুদ্ধে কিন্তু বিপদসীমার বাইরে আসতে চলেছে অনেকের আগেই।                         

    স্রেফ পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে আজ সংক্রমণের অনুপাত ০.৭, মানে ছোঁয়াচ অধিকাংশই কবলে। দেড়লক্ষের ষাট শতাংশ রোগীই সুস্থ। তবু প্রতি মিলিয়নে সংক্রমণের সংখ্যা ১৭০০ - যা বিশ্বের গড় সংখ্যা ৩০০-র তুলনায় অনেকটাই বেশি। তাই নিয়ন্ত্রিতভাবে লকডাউন শিথিল করা একটি সম্মিলিত সিদ্ধান্ত।

    সীমান্তবর্তী জার্মানভাষী আরও দুটি দেশ। একজন অস্ট্রিয়া, প্রতিবেশীর মতই সাবধানী, স্থিতিশীল। অন্যজন সুইজারল্যান্ড, প্রগলভতায় প্রোজ্জ্বল। এককোটিরও কম জনসংখ্যায় মৃত্যু এবং সংক্রমণ দুটোর হারই অনেক উপরের সারিতে। প্রতি মিলিয়নে সংক্রমণ ওর মৃত্যু সংখ্যা যথাক্রমে ৩২০০ আর ১৬০, অর্থাৎ ক্লাসের প্রথম দশ/এগারোতে। তবু, ম্যাটারহর্নের পর্বতশিখরে চিত্রশিল্পী ভাড়া করে আলোর কারসাজি চলছে। পর্যটন মুখ থুবড়ে পড়ার ভয় সলিডারিটির ফ্যাশনে চটক। তাতে নাম লেখাচ্ছেন ভারতীয় দূতাবাস থেকে শুরু করে গদগদ প্রধানমন্ত্রীসহ বহু অনাবাসী ভারতীয়ও।  

    পাহাড়চূড়ার মার্কেটিং আর পরিযায়ী শ্রমিকের প্রাপ্য – সোশ্যাল ডিভাইডের মতই সলিডারিটির দৌড় এখন দু-মুখো।

    ছবি- লেখক। 

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @