No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    হিন্দু-মুসলিমের নমস্য সুন্দরবনের বড়খাঁ গাজির আসল পরিচয় কী? 

    হিন্দু-মুসলিমের নমস্য সুন্দরবনের বড়খাঁ গাজির আসল পরিচয় কী? 

    Story image

    বাঘের দেবতা দক্ষিণ রায়ের সঙ্গে এক পিরের যুদ্ধ লেগেছিল। কৃষ্ণরাম দাসের ‘রায়মঙ্গল’ কাব্যে আছে, ঈশ্বর এই যুদ্ধ থামানোর জন্য অর্ধেক হিন্দু অর্ধেক মুসলমান দেবতা কৃষ্ণপয়গম্বরের রূপ নিলেন। বিচিত্র তাঁর রূপ – “অর্দ্ধেক মাথায় কালা একভাগা চুড়া টালা / বনমালা ছিলিমিলী তাতে। / ধবল অর্দ্ধেক কায় অর্দ্ধ নীলমেঘ প্রায় / কোরান পুরাণ দুই হাতে”। গাজি এবং দক্ষিণ রায়কে শান্ত করলেন তিনি। যুদ্ধবিরতি হল। শর্ত, সুন্দরবনের ভাটি অঞ্চলে দক্ষিণ রায়, হিজলিতে কালু রায়, আর গোটা সুন্দরবনেই গাজি পির শ্রদ্ধা এবং সম্মান লাভ করবেন। ‘গাজিমঙ্গল’ বা ‘গাজির গান’-এ অবশ্য রয়েছে, গাজি সাহেবের কাছে দক্ষিণ রায় পরাজিত হয়েছিলেন। আবার, আব্দুল গফুরের ‘কালু গাজী ও চম্পাবতী’ কাব্যে দেখা যায়, সমস্ত হিন্দু দেবদেবী হয়ে উঠেছে গাজি পিরের বন্ধু এবং পরম আত্মীয়।

    কে এই গাজি পির সাহেব? তাঁর পুরো নাম মোবারক শাহ গাজি বা বড়খাঁ গাজি। সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষ বিশ্বাস করেন, সুন্দরবন অঞ্চলের বেলে আদমপুর অথবা বৈরাটনগর গ্রামে জন্ম হয়েছিল তাঁর। বাবার ছিল প্রচুর ধনসম্পত্তি, কিন্তু সেসবের মায়া ত্যাগ করে অল্প বয়সেই ফকিরের জীবন বেছে নিয়েছিলেন তিনি। বিয়ে করেছিলেন যশোরের ব্রাহ্মণনগরের হিন্দু রাজা মুকুট রায়ের মেয়ে চম্পাবতীকে।

    অনেকে বলেন, বড়খাঁ গাজি কারও ব্যক্তিগত নাম নয়, বাংলায় যে মহান ফকির-দরবেশরা ইসলাম ধর্ম প্রচার করেছিলেন, তাঁরাই এই নামে পরিচিত। কেউ কেউ মনে করেন, ১৫ শতকের পির ইসমাইল গাজিই হলেন বড়খাঁ গাজি। এই গাজি পির আসলে পাণ্ডুয়ার বিখ্যাত পির জাফর খাঁ গাজির ছেলে, সেরকম মতও প্রচলিত আছে। সুকুমার সেন মনে করেন, ১৪ শতকের সুফি খান বড়খাঁ গাজি নামে পরিচিত হন ১৬ শতকে।

    সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষ আজও বিশ্বাস করেন, বড়খাঁ গাজির অলৌকিক শক্তি রয়েছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার খাড়িগ্রামে পুরোনো দিনের বেশ কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে। সেখানে নারায়ণী মূর্তির পাশে ছিল ঘোড়ার পিঠে বসা এই বড়খাঁ গাজির মূর্তি। তাঁর মাথায় টুপি, মুখে লম্বা দাঁড়ি। পরে আছেন পায়জামা-চোগাচাপকান-পিরান। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে বহু মানুষ বড়খাঁ গাজির ভক্ত।

    এখনকার ক্যানিং থানা এলাকায় ঘুটিয়ারি শরিফে বড়খাঁ গাজির কবর রয়েছে বলে ভক্তরা বিশ্বাস করেন। সেখানে যাঁরা তীর্থ করতে যান, তাঁদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান ভেদ নেই। অবশ্য কিছু লোক বলেন বড়খাঁ গাজির কবর এখানে নয়, রয়েছে বাংলাদেশের সিলেটে শিবগাঁও বা গাজিপুর গ্রামে। গোটা দক্ষিণবঙ্গ জুড়েই রয়েছে এই পির সাহেবের বেশ কিছু দরগা-নজরগাহ। নারী, পুরুষ, বৃহন্নলা নির্বিশেষে ভক্তরা ঘুটিযারি শরিফে দূর-দূরান্ত থেকে হাজির হন। মনে করা হয়, ৭ আষাঢ় গাজি পিরের মৃত্যুদিন। প্রত্যেক বছর এই দিন থেকে টানা এক সপ্তাহ ঘুটিয়ারি শরিফে উৎসব এবং মেলা চলে। এই দিনগুলোতে জিয়ারতের সময়ে বারুইপুরের রায়চৌধুরী জমিদারবাড়ি থেকে আনা হয় শিরনি, বাতি-আতর। এগুলোই প্রথমে উৎসর্গ করা হয় পিরকে। গাজি পির রায়চৌধুরী পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা মদনমোহন রায়কে নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর খাজনা থেকে রক্ষা করেছিলেন বলে মনে করা হয়। এখানে পিরোত্তর সম্পত্তি দান করেছিলেন রায়চৌধুরী জমিদারেরা। 

    তথ্যঋণ – তৃপ্তি ব্রহ্ম, জাফরুক হক, ড. বরুণকুমার চক্রবর্তী, বিনয় ঘোষ, সতীশচন্দ্র মিশ্র

    ছবিসূত্র - ব্রিটিশ মিউজিয়াম 

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @