জগজীবনপুরের সেই পাল যুগের রহস্যময় বৌদ্ধ মঠের গল্প

এক অখ্যাত গ্রামের অখ্যাত কৃষক। অন্য দিনের মতোই চাষ করছিলেন মাঠে। ঢিবির মতো উঁচু একটা জায়গায় চাষের জন্য মাটি খুঁড়তে গিয়ে কোদালে শক্ত একটা কিছু আটকে গেল। বেরিয়ে এল এক প্রাচীন তাম্রশাসন। তার একেবারে ওপরে খোদাই করা আছে প্রস্ফুটিত পদ্মের ভেতর বৌদ্ধ ধর্মচক্র, ওপরে ছত্র আর দু’দিকে দু’টি হরিণ। পাল রাজবংশের প্রতীক এটি। কৌতূহলে তিনি খুঁড়ে ফেললেন আরও খানিকটা। সেটা ১৯৮৭ সাল। এরপর খবর দিকে দিকে রটে যায়। খোঁজ পেয়ে হাজির হন আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার লোকজন। তাঁদের খননকার্যে আবিষ্কার হল এক গোটা বৌদ্ধ মঠ।
জায়গাটা এখনকার জগজীবনপুর গ্রামে। জেলা মালদা, ব্লক হাবিবপুর। গোটা অঞ্চল ধানখেত আর জলাশয়ে ভর্তি। চারদিকে বিরাট বিরাট আমবাগান। মালদা স্টেশন থেকে ৪৬ কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার সীমান্তে এর অবস্থান। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে মহানন্দা আর ট্যাঙ্গন নদী। আর সেই অখ্যাত কৃষক, যিনি প্রথম তাম্রলিপি খুঁজে পেয়েছিলেন, তাঁর নাম জগদীশচন্দ্র গাঁই।
গবেষকরা ওই তাম্রশাসনের পাঠোদ্ধার করেছেন। তাম্রফলকের একদিকে সিদ্ধমাতৃকার লিপিতে খোদাই করা আছে ৪০ লাইন। ৩৩ লাইন আরেক দিকে। প্রত্যেক লাইনে ৫০টি করে অক্ষর রয়েছে। তাম্রফলকের নিচে দেখা যায় শ্রী মহেন্দ্রপাল দেবের নাম। লেখা আছে, সেনাপতি বজ্রদেবের অনুরোধে নন্দদীর্ঘিকা উন্দগ্র নামের এক জায়গায় বৌদ্ধ ভিক্ষুদের এই জমি দান করেন সম্রাট মহেন্দ্রপাল। উদ্দেশ্য গৌতম বুদ্ধের উপাসনা এবং ভিক্ষুকদের বসবাস। এভাবেই গড়ে ওঠে একটা মঠ। নাম হয় নন্দদীর্ঘিকা মহাবিহার।
সম্রাট মহেন্দ্রপালের রাজত্বের সপ্তম বছরে তাম্রশাসনটি পুণ্ড্রবর্ধন ভুক্তির ‘কুদ্দাল খাতক’-এর জয়স্কন্ধবার থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। পাল সম্রাট দেবপালের ছেলে ছিলেন মহেন্দ্রপাল। নবম শতাব্দীর কোনো এক সময়ে তিনি পাল পাল সাম্রাজ্য শাসন করতেন। আগে মনে করা হত, পাল সম্রাট দেবপালের পর রাজত্ব করতেন প্রথম বিগ্রহপাল। এই তাম্রফলক খুঁজে পাওয়া গেলে প্রমাণিত হয়, মহেন্দ্রপালই ছিলেন দেবপালের পরবর্তী সম্রাট।
এখন সেই তাম্রশাসন রাখা আছে মালদা জেলা জাদুঘরে। জগজীবনপুর গ্রামে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার উদ্যোগে যে খননকার্য চলে, তাতে বৌদ্ধ মঠের ধ্বংসাবশেষ ছাড়াও পাওয়া গিয়েছিল পোড়ামাটির সিলমোহর, টেরাকোটার মূর্তি, পোড়ামাটির পাত্র এবং আরও অনেক কিছু। সেগুলো এখন মালদা জেলা জাদুঘর এবং কলকাতার ভারতীয় জাদুঘরে স্থান পেয়েছে।