দেশ স্বাধীনে বাঙালিদের অবস্থান স্পষ্ট করে সেলুলার জেলে সংগ্রামীদের নামের তালিকা

ছেঁড়া ফতুয়া গলায় পেঁচিয়ে আত্মঘাতী হয়েছিলেন বিপ্লবী ইন্দুভূষণ রায়। বিপ্লবী উল্লাসকর দত্ত ১৪ বছর বন্দিজীবন কাটিয়েছেন সেলুলার জেলে। অত্যাচরে জর্জরিত বিপ্লবী আক্রান্ত হয়েছিলেন ম্যালেরিয়ায়। শেষে তাঁর জায়গা হয়েছিল কারাগারের লুনাটিক ওয়ার্ডে। অবশেষে ১৯২০ সালে মুক্তি লাভের পরে তিনি ফিরে এসেছিলেন কলকাতায়। শুধুমাত্র এঁরা নন, আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের সেলুলার জেলে (Cellular Jail) ব্রিটিশদের নির্মম অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিল অগণিত স্বাধীনতা সংগ্রামী, বিপ্লবীদের। সেলুলার জেলের অভ্যন্তরে দেওয়ালে খোদিত ফলকে কারাবন্দি যতজন সংগ্রামীর (Freedom Fighter) নামের উল্লেখ পাওয়া যায়, তা থেকে স্পষ্ট হয় দেশ স্বাধীনে বাঙালিদের (Bengali) অবস্থান।
ব্রিটিশ (British) শাসনের শেষ অর্ধে সেলুলার জেলের বন্দিদের বড়ো অংশ ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামী। ফজলে-এ-হক-খয়রাদি, যোগেন্দ্র শুক্ল, বটুকেশ্বর দত্ত, বারীন ঘোষ, শচীন্দ্রনাথ সান্যাল-সহ অসংখ্য বন্দি সেখানে অকথ্য অত্যাচারের শিকার হয়েছেন। অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে অধিকাংশ বন্দি হয় মারা গিয়েছেন, নয়তো আত্মঘাতী হয়েছেন। অনেক সময়েই প্রাণদণ্ড বা অন্য কারণে মৃত বন্দিদের দেহ ভাসিয়ে দেওয়া হত সাগরের জলে।
২০১৯ সালে প্রকাশিত কেন্দ্রিয় সরকারের একটি নথিতে লেখা ছিল ১৯০৯ থেকে ১৯৩৮ সালের মধ্যে আন্দামান সেলুলার জেলে ৫৮৫ জন বন্দির মধ্যে ৩৯৮ জন ছিলেন বাঙালি। জেলের সরকারি ফলকে তাই-ই খোদিত ছিল। যদিও শুভেন্দু মজুমদারের বই অগ্নিযুগের অভিধান-এ (র্যাডিক্যাল ইম্প্রেশন) আরও ২৭ জনের কথা সপ্রমাণ যুক্ত।
১
২
৩
কিন্তু, ২০২১ সালে নজরে আসে সঙ্কুচিত হয়ে গেছে সেলুলার জেলের সেই তালিকা। দীপক রায় নামক এক ব্যক্তি ফেসবুকে সেলুলার জেলের যে নয়া তালিকার ছবি তুলে ধরেন। সেই নতুন ফলকগুলিতে রয়েছে মাত্র ৫১৩ জন বিপ্লবীর নাম। তাঁর মন্তব্যেই উঠে আসে, এই নতুন তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে চার শতাধিক স্বাধীনতা সংগ্রামীর নাম। এই তালিকা প্রকাশ্যে আসার পরেই রীতিমতো চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়েছিল সোশ্যাল মিডিয়ায়।
পুরোনো তালিকায় প্রতি বিপ্লবীদের নামের পাশে উল্লিখিত ছিল তাঁরা কত সালে এই জেলে বন্দি হয়ে এসেছিলেন। নতুন তালিকায় এই ধরনের কোনো উল্লেখ নেই। বরং ১৯০৯–১৯২১, ১৯২২–১৯৩১ এবং ১৯৩২–১৯৩৮ সাল। এই তিনটি পর্যায়ে ভাগ করে নেওয়া হয়েছে পুরো সময়সীমাকে। বাদ গেছে ১৯০৯ সালের আগের বিপ্লবীদের নামও।
সারা পৃথিবীতে যতগুলি জাতীয় মুক্তি আন্দোলন হয়েছে, তার মধ্যে ভারতের সংগ্রামের ব্যাপ্তি সবচেয়ে বেশি এবং একই সঙ্গে বৈচিত্রপূর্ণ। এই আন্দোলনের ধারায় নানা প্রদেশ, শ্রেণি, গোষ্ঠীর আন্দোলন একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে। উনিশ শতকের শেষে পরাধীন ভারতে তুঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রাম। ফাঁসির পাশাপাশি সশস্ত্র পথের বিপ্লবীদের বেশিরভাগেরই শাস্তি হয়েছিল দ্বীপান্তর। সেই সময় ব্রিটিশ সরকার বুঝল, এ বার আন্দামানে দরকার নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা সমেত একটি কারাগার।
মূলত ব্রিটিশ রাজকর্মচারী চার্লস জেমস ল্যাল এবং চিকিৎসক এ এস লেথব্রিজের মস্তিষ্কপ্রসূত ছিল সেলুলার জেল। ১৮৯৬ সালে শুরু কারাগার নির্মাণের কাজ। শেষ হয় ১৯০৬ সালে। তৎকালীন বর্মা থেকে ঘন লাল রঙের ইট এনে প্রথমে তৈরি হয়েছিল কারাগার।
কারাগার ভবনের সাতটি শাখা ছিল। কেন্দ্রে ছিল টাওয়ার। যেখান থেকে রক্ষীরা নজরদারি চালাতেন। বাইসাইকেলের চাকায় যেমন স্পোক থাকে, সে ভাবে কেন্দ্র থেকে বিস্তৃত ছিল শাখাগুলো। ‘সেলুলার জেল’ নাম এসেছে ‘সেল’ বা প্রকোষ্ঠ থেকে। কারাগারে মোট ৬৯৬টি সেল ছিল। ১৪.৮ x ৮.৯ ফিটের প্রকোষ্ঠগুলিতে থাকত একটি মাত্র ঘুলঘুলি। সেটাও মেঝে থেকে ৯.৮ ফিট উচ্চতায়।
প্রকোষ্ঠগুলি এমন ভাবে বানানো হয়েছিল, যাতে কোনও বন্দি অন্য কারও মুখ দেখতে না পারেন। ফলে তাঁদের মধ্যে যোগাযোগের কোনও উপায় ছিল না। এ ভাবেই ‘সলিটারি কনফাইনমেন্ট’-এর ব্যবস্থা করেছিল ব্রিটিশ সরকার।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ১৯৪১ সালে ব্রিটিশদের হাত থেকে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ অধিকার করে জাপানি শক্তি। পোর্ট ব্লেয়ারে পতাকা উত্তোলনের পাশাপাশি আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপের নতুন নামকরণ করেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। ‘শহিদ’ ও ‘স্বরাজ’ দ্বীপ। তবে অবস্থা পরিবর্তিত হয়ে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযু্দ্ধে জাপানের পতনের সঙ্গে। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপের কর্তৃত্ব আবার চলে যায় ব্রিটিশদের হাতে।
বর্তমানে সেলুলার জেল ভারতের অন্যতম জাতীয় স্মারকসৌধ। পোর্ট ব্লেয়ারে পর্যটকদের প্রধান গন্তব্য। ১৯৬৩ সালে কারাগারে তৈরি হয় গোবিন্দ বল্লভ পন্থ হাসপাতাল। বর্তমানে এটি ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট একটি হাসপাতাল।
তথ্যঋণঃ www.literacyparadise.com, আনন্দবাজার পত্রিকা, উইকিপিডিয়া