বর্তমানে বিপন্ন হয়ে উঠেছে বাংলার বিভিন্ন প্রজাতির বন্য বিড়াল

“সুখের অত্যন্ত কাছে বসে আছে অসুখী বিড়াল”
---শক্তি চট্টোপাধ্যায়
বিড়াল আর মানুষের গেরস্থালি কম দিনের নয়। পোষ্য হিসাবে জনপ্রিয় প্রাণীদের তালিকায় একেবারে উপরের দিকে থাকবে বিড়াল। তাদের প্রতি মানুষের মমত্বেরও শেষ নেই। বিভিন্ন রঙের পেলব লোমে ঢাকা শরীরের এই প্রাণীটি আদ্যন্ত আদুরে। তাদের স্বভাবচরিত্রও তাদের প্রতি স্নেহের উদ্রেক ঘটায়। মালিকের খাবারের পাতের কাছে চুপ করে বসে থাকা, আলগা রোদে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে থাকা, বা পছন্দের মানুষকে দেখলে তার গায়ে গা ঘষা বা মৃদু স্বরে ডাক, সবকিছুর মধ্যেই মানুষ চিরকাল সারল্য খুঁজে পেয়েছে। আবার মাছ বা দুধ চুরি করে খাওয়ার মধ্যে খুঁজে পেয়েছে শিশুর দুষ্টুমির অনুষঙ্গ। ইঁদুরের বাড়বাড়ন্ত কমিয়ে পরোক্ষে ফসলের রক্ষাও করে বিড়াল। তবে বিড়াল শুধু গৃহপালিত পশু নয়। এমন অনেক ধরনের বিড়াল আছে, যারা জঙ্গলে বসবাস করে। তাদেরকে একত্রে বন্য বিড়াল (Wild Cats) বলে ডাকা হলেও তাদের মধ্যে আছে আলাদা আলাদা প্রজাতি। বাংলায় মোট তিন চার রকমের বন্য বিড়াল দেখতে পাওয়া যায়।
মানুষ ঠিক কবে থেকে বিড়াল পুষতে শুরু করল, তার সঠিক হদিশ দিতে পারেননি ইতিহাসবিদরা। প্রাচীন মিশরে বিড়ালকে দেবতা রূপে পুজো করা হতো। অনেকে বলেন, আফ্রিকার বন্য বিড়াল ফেলিস সিলভেসটারসিস থেকেই বর্তমান গৃহপালিত বিড়াল-এর উৎপত্তি। পশ্চিম এশিয়ায় প্রাক-ইসলামিক যুগ থেকেই বিড়াল পোষার প্রমাণ পাওয়া গেছে। পৃথিবীর তাবড় তাবড় সাহিত্যিকদের পোষ্য বিড়াল। সাহিত্যেও তাদের অবাধ গতিবিধি। কে ভুলতে পারবে সুকুমার রায়ের লেখা ‘হযবরল’-এর সেই বিড়ালকে, যে গেছোদাদার ঠিকানা বলতে গিয়ে লেখকের মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছিল? সত্যজিৎ রায়ের বিভিন্ন গল্পে ঘুরেফিরে এসেছে বিড়ালের প্রসঙ্গ। তাঁর সৃষ্ট বিখ্যাত চরিত্র প্রোফেসর শঙ্কুর প্রিয় পোষ্য একটি বিড়াল, নাম নিউটন।
বাঘরোল
মানুষ ঠিক কবে থেকে বিড়াল পুষতে শুরু করল, তার সঠিক হদিশ দিতে পারেননি ইতিহাসবিদরা। প্রাচীন মিশরে বিড়ালকে দেবতা রূপে পুজো করা হতো। অনেকে বলেন, আফ্রিকার বন্য বিড়াল ফেলিস সিলভেসটারসিস থেকেই বর্তমান গৃহপালিত বিড়াল-এর উৎপত্তি।
তবে পোষ্য বিড়ালের সঙ্গেই পরিবেশে সহাবস্থান করে বন্য বিড়াল, যাদের উপস্থিতি প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলার রাজ্য প্রাণী হলো বাঘরোল, যা বিড়াল জাতীয় প্রাণী। এটি মাঝারি আকৃতির বন্য বিড়াল। পাওয়া যায় সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জুড়েই। জলা অঞ্চলে সোঁদা মাটি, আর নাম না জানা ফুলের গন্ধে মাতাল প্রজাপতির দল খেলা করে, আর ঘাটের কাছে বা গাছের ডালে নিঃশব্দে মাছ শিকারের অপেক্ষায় বসে আছে বাঘরোল, এ দৃশ্য প্রায়ই দেখা যেত গ্রামাঞ্চলে। আদিবাসীরা যার নাম দিয়েছেন, জল-বিলাই। এদের শরীরের উপর দ্বিস্তরীয় লোমের আবরণ এদের শরীরকে জলে ভিজতে দেয় না।
মার্বেলড-ক্যাট
আর রয়েছে মার্বেলড বিড়াল (Marbled Cat)। বাদামি রঙের মসৃণ লোমের উপর হালকা বাদামি ছোপ। প্রতিটি ছোপ আবার সূক্ষ্ম কালো রঙে ঘেরা। এরা সাধারণত পাখি শিকার করে। কখনও কখনও বাসা ভেঙে পাখির ডিমও নিয়ে যায়। বেশ কিছুদিন আগেও বক্সার জঙ্গলে এদের দেখা মিলতো।
এশিয়ান সোনালি বিড়াল
মার্বেলড বিড়ালের সমগোত্রীয় আরেকটি শ্রেণী হলো এশিয়ান সোনালি বিড়াল, যা প্রায় ৮.৪২ মিলিয়ন বছর আগে বিবর্তনের ধারায় মার্বেলড বিড়াল গোষ্ঠীর থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিল। বিড়ালগুলি সাধারণত ধূসর-লাল বা সোনালি রঙের লোমযুক্ত হয়ে থাকে। তবে কালো বা বাদামি রঙের এশিয়ান সোনালি বিড়ালও দেখা যায়। এরা গাছে উঠতে পটু। ছোটো পোকামাকড়, সরীসৃপ, ব্যাঙ, পাখি এদের প্রধান খাদ্য। তবে মাঝে মধ্যে বাছুর বা সম্বর হরিণের ছানাও শিকার করতে দেখা গেছে। রাতচরা এই বিড়াল দেখা যায় উত্তরবঙ্গের বক্সার জঙ্গলে।
জাঙ্গল ক্যাট
বাংলায় আরও এক ধরনের বন্য বিড়াল দেখা যায়, যার নাম জাঙ্গল ক্যাট। পর্ণমোচী অরণ্যে বা জলাভূমিতে এদের বাস। দেখা যায়, তারা হয়তো “…কৃষ্ণচূড়ার গায়ে নখ আঁচড়াচ্ছে/ সারাদিন সূর্যের পিছনে-পিছনে চলেছে সে। একবার তাকে দেখা যায়, একবার হারিয়ে যায় কোথায়”। তখন হয়তো সে শিকার করতে গেছে তার অন্যতম প্রিয় খাদ্য গৃহপালিত হাঁস-মুরগি। তাদের গায়ে লালচে বাদামি বা হলদেটে লোম, লেজ আর কানে কালো ছোপ, নাক আর গলার নীচে সাদা ছোপ। জঙ্গলের ঝরা পাতার রাস্তায় যেখানে এসে পড়েছে গোধূলির মৃদু আলো, তারপর ফিকে হতে হতে নেমে এসেছে আধো অন্ধকার, সেখানে লম্বা লেজ আর লম্বা পায়ের এই বিড়ালকে “হেমন্তের সন্ধ্যায় জাফরান-রং-এর সূর্যের নরম শরীরে শাদা থাবা বুলিয়ে-বুলিয়ে খেলা করতে” দেখে ফেলেন বনপথে হেঁটে আসা কোনও কাঠুরিয়া।
কিন্তু সমস্ত রোমান্টিসিজমকে বাস্তবের দিকে তাকালে দেখা যাবে বাংলার বন্য বিড়াল (Wild Cats of Bengal)-এর অস্তিত্বের সংকট। বর্তমানে প্রায় প্রতিটি বন্যবিড়ালের সংখ্যা উদ্বেগজনক ভাবে কমে এসেছে। বাঘরোল আছে আইইউসিএনের (IUCN) বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীর তালিকা-তে, ২০১৬ সাল থেকে। বক্সার জঙ্গলে এখন কদাচিৎই দেখা মেলে মার্বেলড বিড়ালের। দূষণ, জলাভূমি বুজিয়ে ফেলা, অবাধে জঙ্গল কাটা এদের বিপন্নতার বড়ো কারণ। তার উপর এদের অনেকের চেহারার সঙ্গে চিতাবাঘের চেহারার সাদৃশ্য থাকায় গ্রামাঞ্চলে মানুষ অনেকসময় পিটিয়ে মেরে ফেলেন প্রাণীটিকে। এই ঘটনা থামাতে শুরু হয়েছে সচেতনতার প্রসার করা। রাজ্য বনদপ্তর আর বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষ থেকে। মানুষকেই নিতে হবে এদের সংরক্ষণের দায়িত্ব। নয়তো বাস্তুতন্ত্রে তো প্রভাব পড়বেই, সঙ্গে হারিয়ে যাবে মানুষের অন্যতম প্রিয় প্রাণীর একটা গোটা শ্রেণী/গোষ্ঠী।