রামচন্দ্র গোয়েঙ্কা জেনানা স্নান ঘাট

শহরের নয়া হুজুক। এমন হুজুকের নাম ‘জেনানা ফাঁকি’। আসলে ফাঁকে ফোঁকোরে, ফাঁকতালে রমণী মানে জেনানার চোখ ফাঁকি দিয়ে তাদের নিটোল শরীরে একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়ার অভ্যেস। ওদিকে জেলে পাড়ায় সঙ উঠলো। সঙের গানে শোনা গেল- ‘অবিদ্যা পাড়ায় ঝেঁটা/ ঘরে সতীনের লাথি/ মরদের কপালে জোটে গঙ্গার ঘাটি’। এমন গাওন কথাতেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে একদল পুরুষ তখন গঙ্গার ঘাটে গিয়ে জেনানা দর্শনে মেতে উঠেছেন। ম্যাজিস্ট্রেটদের রাতের ঘুম উঠলো। ডেপুটিরা পাইক বরকন্দাজ লাগাতে লাগলো দিকে দিকে। কিন্তু এমন অভ্যাসে লাগাম দেওয়াতেও বজ্জাতের চেষ্টা নেই। কলকাতায় তখন এক নয়া বিপদ। এদিকে শহর কলকাতা তখন মহারাণীর খাস তালুক। সবকিছুতেই পবিত্রতা রক্ষার নয়া ফর্মান এসেছে খোদ ইংল্যান্ড থেকে। বিলিতি ভাষায় এমন ফর্মানকে পণ্ডিতরা বলে থাকেন- ‘পিউরিটান যুগ’। মেয়েদের বনেদি ঘরে হাতে উঠলো দস্তানা। শুধু কী তাই চেয়ার টেবিল সবই ঢাকা দেওয়া হতে লাগলো নকশা বোনা কাপড়ে। সামান্যতম খোলা জায়গাও নগ্নতার তকমা পেয়ে যেতে পারে।
এই রকম সময়ে জেনানা ফাঁকি হুজুক বড়ই বিচলিত করে তুললো সকলকে। ঠাকুরবাড়ির মেয়ে-বউরা অভ্যেসমত গঙ্গায় গিয়ে পালকি ডুব দেয়। এমন সুযোগ তো সকলের নেই। ভিনদেশী ব্যবসায়ীদের মেয়ে-বউরা গঙ্গা স্নানে যায়, গঙ্গা স্নানে যায় বাঙালি শেঠ বসাক কিংবা ঘোষ বাড়ির মেয়ে-বউরাও।
এবার জেনানা ফাঁকির বিপরীতে যুদ্ধে নামলেন রাজস্থান থেকে আগত ব্যবসায়ী রামচন্দ্র গোয়েঙ্কা। তিনি তরিযুত করে গঙ্গার ঘাটে চারপাশ ঘিরে জেনানা ঘাট তৈরি করে ফেললেন। নিজের পরিবারের রক্ষণশীল দুহিতারা তো বটেন, এই ঘাটে নিরাপদে স্নান করতে লাগলো আরও অন্যান্য ঘরের মেয়ে বউরাও। কলকাতার বুকে সেদিন বঙ্গ ভাষা-ভাষী না হয়েও শুধু নিজের বাড়ির জন্যই নয় বাংলা মুলুকের অজস্র নারীর সম্মানের কথা ভেবেছিলেন এই মানুষটি। পাইক বরকন্দাজ লাগানোর মত প্রশাসনিক ক্ষমতা হয় তো তাঁর ছিল না। কিন্তু নারী জাতির সম্মান রক্ষার্থে তাঁর এই কর্মকাণ্ড বাঙালি চিরকাল মনে রাখবে।
সেদিনের নয়া ইফটিজারদের বিরুদ্ধে লড়াই করার এক বিরল সাক্ষী হয়ে আজও গঙ্গার ঘাটে এই রাজস্থানি শৈলীর জেনানা স্থাপত্য দাঁড়িয়ে রয়েছে। যার নাম গোটা গোটা ইংরেজি অক্ষরে লেখা ‘RAM CHANDRA GOENKA ZENANA BATHING GHAT’। এমন মানুষদের বাঙালিরা বাংলার মানুষ হিসাবেই দেখে এসেছে চিরকাল। সেই দেখা আজও আবছা নয়।