সব মূর্তি নিছক ‘মূর্তি’ হয় না

হীরক রাজার দেশে-তে স্বয়ং হীরকরাজ পাঠশালা বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন। তার ফলস্বরূপ রুখে দাঁড়িয়েছিল দেশের যুবসম্প্রদায়। এমনকি রাজার মূর্তি নিয়েও বেশ হইচই হয়েছিল। সেসব এখন অতীত। অতীত? প্রশ্নটা এখানেই। রাজা এবং প্রজা অর্থাৎ সমাজের একেবারে ধনী ব্যক্তি এবং একেবারে গরিব ব্যক্তির একটা বিশাল ব্যবধান আমাদের ভারতবর্ষে। এই দুই শ্রেণির মাঝে ঠাঁসা ঘর্মাক্ত মধ্যবিত্ত এক্কেবারে বিলুপ্তপ্রায়। যিনি বড়োলোক তিনি বেশি ধনী হচ্ছেন, যিনি গরিব তিনি সর্বস্ব হারাচ্ছেন। এটাই হল রাজা-প্রজা-রাজনীতি। তাছাড়া কথায় আছে রাজনীতি মানে রাজার নীতি। যা শুধুমাত্র সামাজিকভাবেই নয়, অর্থনীতি এবং সংস্কৃতিতেও চরম প্রভাব ফেলেছে। এই ভারতবর্ষ স্বাধীনতার সত্তর বছর পার করে এসেছে। ভারতীয় রাজনীতিতে খুব একটা বদল দেখতে এই দেশ অভ্যস্থ নয়। আজ ২০১৯ সালে দাঁড়িয়ে বারবার একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের নামই উঠে আসছে৷ ক্ষমতায় পাঁচবছর থাকার পরেও বিশেষ কোনো কাজ করতে ব্যর্থ হওয়ায় আরও পাঁচবছর সময় চেয়ে নেন আপামর দেশবাসীর কাছে। ভারত সহিষ্ণুতা আর ধর্মনিরপেক্ষতার দেশ। ভারত পাঁচমিশালি খাদ্য-পোশাক-বাসস্থানের দেশ। যে দেশের নির্দিষ্ট কোনো রাষ্ট্রীয় ভাষা নেই। নেই বলেই সমস্ত ভাষা এক আত্মার আত্মীয়।
গত ১৪ মে সন্ধেবেলা একটি রাজনৈতিক দলের রোড শো-কে ঘিরে কলকাতার কলেজস্ট্রিট চত্বর উত্তাল হল। এমনকি এই শহর আরেকবার সাক্ষী থাকল মূর্তি ভাঙার এক নোংরা ঘটনায়। এর আগেও সত্তরের দশকে কলেজস্কোয়ারে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা হয়েছিল। খুব সম্প্রতি যে ঘটনাগুলো মনে পড়ছে তা বিচ্ছিন্ন হলেও এ আমাদের সাংস্কৃতিক ক্ষয়, মূল্যবোধের ক্ষয়, শিক্ষার ক্ষয়। ত্রিপুরায় লেনিন মূর্তি ভাঙা (লেনিন কমিউনিস্ট ছিলেন), তামিলনাড়ুতে পেরিয়ারের মূর্তি ভাঙা (পেরিয়ার দ্রাবিড় আন্দোলনের নেতা ছিলেন), উত্তরপ্রদেশে আম্বেদকর মূর্তি ভাঙা (আম্বেদকর দলিত ছিলেন), ত্রিপুরায় সুকান্ত ভট্টাচার্যের মূর্তি ভাঙা (তিনি কমিউনিস্ট ছিলেন), ব্যারাকপুরে মৌলানা আবুল কালাম আজাদের মূর্তি ভাঙা (তিনি মুসলিম ছিলেন), আসামে রবীন্দ্রনাথের মূর্তি ভাঙা (তিনি সিস্টেমের বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন) আর এখন বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা হল। প্রকাশ্যে। ভারতের আরেকদিকেই কিন্তু মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছেন বল্লব ভাই প্যাটেল। সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু লৌহপুরুষ। সেই মূর্তির তুলনায় অতি ক্ষীণ দু-চারটে বিক্ষিপ্ত ঘটনা। বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু মূর্তিটি কিন্তু দেখে ফেলছে আরও কিছু মূর্তির ভাঙন। আমরা মানে বাঙালিরা ‘বর্ণপরিচয়’-এর অক্ষর চিনে বড়ো হয়েছি। এই বই আমাদের মাতৃযোগ এবং নাড়ির টানের কথাই বারবার বলে। সেই ভাষা, সেই সংস্কৃতি, সেই শিক্ষার অপমান আমাদের গায়ে লাগবে না? আমরা সোচ্চার হব না? আমাদের এখনও যে মেরুদণ্ড আছে এবং আমরা বিকৃত ও বিক্রীত হয়ে যাইনি, তা কি জানান দেব না?
সবার আগে যে দু’জন মানুষ (আরেকজন রামমোহন) ধর্মীয় গোঁড়ামি ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, বিদ্যাসাগর তাঁদের একজন। চরম ফ্যাসিবাদ যখন তার সর্বশক্তি দিয়ে আমাদের গ্রাস করে, তার ঠিক বিপরীতে দাঁড়িয়ে সাধারণ মানুষেরও সর্বশক্তি দিয়ে রুখে দাঁড়ানো উচিত। বিদ্যাসাগর বা বিবেকানন্দ যেই হোক না কেন, সঠিক আদর্শ বা আদর্শের যুক্তি না জেনে একপ্রকার হানাহানি এবং শানিত অস্ত্রের আওয়াজ। আসল কথা হচ্ছে রক্তের বিকল্প যদি রক্ত হয়, অস্ত্রের বিরুদ্ধে যদি আরও কিছু অস্ত্র ঝনঝনিয়ে ওঠে, খুনের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে যদি আরও একটা খুন করে ফেলি তাহলে ভারত কোনোভাবেই সহিষ্ণু হতে পারবে না। আমাদেরই তো জানান দিতে হবে এটা ভারত নয়, এটা ভারতের সংস্কৃতি নয়। বাংলায় বাঙালি সংস্কৃতির এহেন অপমান অবর্ণনীয়।
আমরা উনিশ শতক পড়ি। পড়তে পড়তে মনে হয় বাঙালি তখন যা ছিল, এখনও তাই আছে। সমাজ বা রাজনীতিই শুধু নয়, ধর্ম, জাত, বর্ণ, ভাষা, নারী-স্বাধীনতা- ছবিটা এখনও এক। একবার ভাবুন, বিস্যাসাগর দামোদর পার করছেন। নদীর ওপারে একদল হিংস্র মানুষ ধেয়ে আসছে যুদ্ধ যুদ্ধ রব নিয়ে। বিদ্যাসাগর হাসিমুখে নদী পার হচ্ছেন। এই সেই ভদ্রলোক, যিনি নিজের ধর্ম-চাকরি কিচ্ছু নিয়ে কোনোদিন মাথা ঘামাননি। ব্যক্তিগত আপোষ করেননি। একটা চাপা জেদ তাঁকে বর্ণপরিচয়ের ভাষা দিচ্ছে। তাঁর ভাষাতেই আমাদের মা শেখাচ্ছেন শিকড়ের টান, নাড়ির যোগ। বিদ্যাসাগর দামোদর পার হবেন। হীরক রাজা পাঠশালা বন্ধ করতে পারবেন না। ছড়িয়ে দেওয়া হবে বর্ণপরিচয়। বিদ্যাসাগর মুচকি হাসবেন শুধু।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)