যেখানে ছোট্ট নীল হ্রদে মুখ দেখে সোনার পাহাড়

পাহাড়ের মাথায় একচিলতে জায়গা। লাল তিনকোণা ছাদের একটা বাড়ি। সামনে নীল জলে ছায়া পড়েছে আকাশের। সেই জলের খানিকটা জমে বরফ। সেই জলেই কেঁপে কেঁপে উঠছে বরফশৃঙ্গের ছায়াও। কাঞ্চনজঙ্ঘা। সঙ্গে উজাড় করা নীল আকাশ, স্তব্ধতার গান। এখানে এলে নেশা লাগবেই।
কথা হচ্ছিল টোংলু নিয়ে। সান্দাকফু (৩৬৩৬ মিটার বা ১১,৯২৬ ফুট, পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ স্থান) ট্রেকের পথে পড়ে। যদিও যারা সান্দাকফু যান তারা টোংলুতে খুব একটা থাকেন না। টোংলুকে পাশ কাটিয়ে টুমলিং চলে যান, নয়তো আরেকটু এগিয়ে গিয়ে থাকেন জোবারি বা গৈরিবাস। আর যারা টোংলুতে একবার থাকেন, এ জায়গার মায়া তারা আর কাটাতে পারেন না সারাটাজীবন। এ এক ফাঁদ বলা যায়। উচ্চতা ৩০৩৬ মিটার (৯৯৫৮ ফুট)। সান্দাকফু পর্যন্ত গাড়ি যায়, ফলে টোংলু যাওয়া যায় গাড়িতেই। তবে, টোংলুর ম্যাজিক ছুঁতে চাইলে গাড়িতে নয়, যেতে হবে পায়ে হেঁটেই।
সান্দাকফু যাওয়ার পথ
টোংলুর কথা লিখতে বসলেই অসংখ্য স্মৃতি ভিড় করে আসে। বড়ো প্রিয় জায়গা। প্রথমবার টোংলু গিয়েছিলাম সান্দাকফু ট্রেকের পথে প্রথমদিন থাকার জন্যে। তারপর, উল্টোদিক থেকে ফালুট গেলেও আর কখনও সান্দাকফু যাওয়া হয়নি। মন আটকে গেছে টোংলুতে। বারবার শুধু টোংলুর জন্যেই টোংলু গেছি আর নতুনভাবে আবিষ্কার করেছি একে।
যখনই কাউকে জিজ্ঞাসা করি, টোংলু সান্দাকফুর চেয়ে কম কীসে? উত্তর পাই, ১) সান্দাকফু টোংলুর থেকে ২০০০ ফুট মতো উঁচুতে, ২০ কিমি মতো উত্তরে। মানে কাঞ্চনজঙ্ঘার আরও কাছে। যদিও এই দূরত্ব ওই বিশালতার কাছে কিছুই নয়। ২) সান্দাকফু থেকে এভারেস্ট-রেঞ্জটাও দেখা যায়। কিন্তু, ব্যক্তিগতভাবে পৃথিবীর সর্বোচ্চ শিখরটির থেকে আমার কেন জানি না তৃতীয়টিকে অনেক বেশি মনে ধরে।
মেঘমা
নিউ জলপাইগুড়ি থেকে ৭০কিমি দূরে ঘুম। সেখান থেকে ১২ কিমি দূরে সুখিয়াপোখরি হয়ে আরও ৭কিমি গিয়ে মানেভঞ্জন। জমজমাট জায়গা। এখান থেকে টোংলু পায়ে হেঁটে ১১ কিমি। পাইন গাছে ঘেরা রাস্তা ধরে চিত্রে পর্যন্ত প্রথম ৩কিমি বেশ চড়াই। পাহাড়ের গোড়া থেকে তার ওপরে চড়লে যা হয়! চিত্রে হল আরেকটা মন ভালো করে দেওয়া জায়গা। থাকার জায়গা, চায়ের দোকান আছে। আর আছে চর্তেন, সঙ্গে প্রেয়ার ফ্ল্যাগ। এটা গোটা রাস্তায় অনেক জায়গাতেই আছে অবশ্য। এরপর অলীক সুন্দর এক পথে (গাড়ির রাস্তা ছেড়ে শর্ট রুট নেওয়াই বাঞ্ছনীয়) চলা, মানে হালকা চড়াইয়ে ওঠা। পথে পড়বে লামেধুরা। ঝুপরি দোকানে চা-ম্যাগি-মোমো-ডিমসেদ্ধ পাওয়া যায়। একটু জিরিয়ে নিয়ে এসব না খেলে ক্লান্ত হয়ে যাওয়া পাগুলো অভিশাপ দেবে। হয়ে গেলে উঠে পড়ুন। হাঁটতে হবে। নতুনদের জন্য পাহাড়ি রাস্তায় ১১কিমি মুখের কথা নয় কিন্তু। একদিনেই হাইট গেইন প্রায় ৪০০০ ফুট।
সোনারঙ বুদ্ধ
লামেধুরা থেকে আবারও চড়াই রাস্তায় বেশ অনেকটা উঠে মেঘে ঢাকা মেঘমা পৌছে রাস্তাটা দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে। একটা উঠে গেছে টোংলু। আর বাঁ দিকেরটা টোংলু পাহাড়টাকে পাশ কাটিয়ে টুমলিং চলে গেছে। শেষের চড়াইটা বেশ চড়া। মনে হতেই পারে আর কতদূর? জিজ্ঞাসা করবেন না। পাহাড়ে এই প্রশ্নটা বারণ। প্রতিবারই এই শেষ অংশটায় যখন পৌঁছাই তখন দুপুর ১২টা বেজে যাওয়ার কারণে আবহাওয়া খারাপ হতে থাকে। মেঘে ঢাকা রাস্তায় আস্তে আস্তে উঠতে থাকুন। ঠিক পৌঁছে যাবেন প্রকৃতির কোল আলো করে থাকা ছোট্ট টোংলুতে।
আরও পড়ুন
চা-বাগানে কয়েকদিন
শুধু টোংলুর ট্রেকারস হাটে থাকার জন্যই বারবার যাওয়া যায়। সামনেই ঘুমন্ত বুদ্ধ। কাঞ্চনজঙ্ঘা। পাশের ছোট্ট লেকটায় কখনও বরফ ভাসা জল, তাতে প্যাঁক প্যাঁক শব্দে খেলে বেড়ানো হাঁস, কখনও শুধুই শুকনো খটখটে মাটি। রাতের টোংলুর আকাশ ভরা তারার মাঝে খুব পরিচিত সপ্তর্ষিমন্ডল অথবা ক্যাসিওপিয়াও হারিয়ে যায়। নভেম্বরের ঝকঝকে আকাশ, ডিসেম্বর-জানুয়ারির ঠান্ডায় জমে যাওয়া হাত, গরম স্যুপ, পাকোড়া, উফফ!
হাত বাড়ালেই কাঞ্চনজঙ্ঘা
ভোরের আলো ফোটা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ায় চূড়ায় আলোর খেলা শুরু। এর বর্ণনা করে লাভ নেই। অনেকেই জানেন। না জানলে সশরীরে উপস্থিত হয়ে পড়ুন। যে বিখ্যাত ‘ঘুমন্ত বুদ্ধ’-এর কথা আমরা শুনি তার মাথাটা হল কুম্ভকর্ণ, পেটটা কাঞ্চনজঙ্ঘা আর পা হল পান্ডিম। কাঞ্চনজঙ্ঘার সামনে যে তুষারাবৃত বিভিন্ন শৃঙ্গ দেখা যায় তার মধ্যে আছে বিখ্যাত কাবরু নর্থ, কাবরু সাউথ, রাথং, ফ্রে, কোকথাং ইত্যাদি। আরও একটু ভালো ‘ভিউ’র জন্যে টোংলু টপে যেতে পারেন। উল্টোদিকটায় মদন তামাং-এর সমাধি। পাশেই ইন্দো-নেপাল সীমান্তের নিশান ফলক। এই রুটটার এই এক মজা। এই ভারতের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি তো এই নেপাল। সীমানা বরাবর আঁকাবাঁকা পথে হাঁটা।
চিত্রে
এদিনই প্রাতরাশের পর ২কিমি দূরে টুমলিং ঘুরে আসুন। খুব সুন্দর জায়গা। কয়েকটা হোটল/ হোম-স্টে আছে। সারাদিন নিজের মতো এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ান। পরদিন নেমে আসুন মানেভঞ্জন। ওঠার চেয়ে স্বাভাবিকভাবেই কম সময় লাগবে। আর মানেভঞ্জন থেকে বিকেল পর্যন্ত গাড়ি পাওয়া যায় নিউ জলপাইগুড়ি ফেরার।
ফিরতে মন চাইছে না? আচ্ছা, আবার যাবেন না হয়। সব মিলিয়ে ৩ দিন ২ রাতের তো মাত্র ব্যাপার। কোনও একটা শুক্র বা সোম ছুটি থাকলেই টুক করে টোংলু।
কীভাবে যাবেন?
ট্রেনে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে বা আকাশপথে বাগডোগরা থেকে গাড়িতে মানেভঞ্জন। এখান থেকে হাঁটাপথ। চাইলে গোটাটাই গাড়িতে যাওয়া যায় অবশ্য।
কোথায় থাকবেন?
টোংলুতে ট্রেকার্স হাট। নতুন আরেকটা থাকার জায়গাও হয়েছে পাশে।
কোথায়, কোথায় ঘুরবেন?
গোটাটাই পায়ে হেঁটে ঘোরার পথ। টুমলিং। চাইলে ঘুরে আসতে পারেন সান্দাকফুও।
কখন যাবেন?
সেরা সময় অক্টোবর, নভেম্বর, মার্চ, এপ্রিল।
ছবি- লেখক