বরফে কোমর অবধি ডুবে যাচ্ছে, হাত-পা অসাড় ঠান্ডায়

অজানাকে জানার আকর্ষণ মানুষের আজীবন। যা দেখা যায় না, যা জানা যায় না, যা কল্পনাও করা যায় না, মানুষকে তাই তো টানে আরো বেশি করে। সেই হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে বেরিয়েছে, রাস্তা আপন করে নিয়েছে, নতুন পৃথিবী খুজে বের করেছে, বাকি দুনিয়াকে জানিয়েছে, সভ্যতা বিজ্ঞান সংস্কৃতি এগিয়েছে। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ আসলে অভিযান সংগঠিত করে গিয়েছে।
আমরাও প্রস্তুতি শুরু করলাম আমাদের অভিযানের। হিমালয়ে আল্পাইন ক্লাইম্বিং-এর। লক্ষ্য কোয়ারাং রেঞ্জের চার শৃঙ্গ। ক্লাইম্বার হিসেবে আমরা দুজন, মানে আমি আর সুমন সরকার। সঙ্গে বেসক্যাম্প মেম্বার হিসেবে প্রাথমিকভাবে ঠিক হল অমিত মুখার্জি, সৌরভ কুমার আর অভীক লাহা। আমি বাদে পুরো টিম রওনা দিল ট্রেনে করে, জুনের মাঝামাঝি সময়ে চণ্ডীগড় হয়ে মানালির উদ্দেশ্যে।
চাকরির সূত্রে ছুটি মিলল আমার আরো তিনদিন পরে, আমি রওনা দিলাম তারপরে। ফলে, প্রাথমিক চাপ গিয়ে পড়ল পুরো সুমনের উপরেই। হিমালয়ে অভিযানের প্রস্তুতি এমনিতেই ভীষণ কষ্টসাধ্য কাজ। তার ওপর, বাকি টিম অভিযানের প্রস্তুতি সম্পর্কে অনভিজ্ঞ।
জুতো ভাড়া থেকে সব্জি বাজার, প্যাকিং-চেকিং থেকে গাড়ি বুক-- গোটা চাপটা একা সামলে সুমন এমনিতেই ক্লান্ত হয়ে পড়ল। আমি কলকাতা থেকে যাত্রা শুরু করে চণ্ডীগড়-মানালি হয়ে সোজা ওদের ধরলাম পাটসিওতে। মানালি থেকে রোটাং পাস পেরিয়ে বারালাচা পাসের আগে ছোট্ট একটি জায়গার নাম পাটসিও, থাকার মধ্যে রয়েছে দুটি আর্মি ক্যাম্প, একটি গ্লেসিয়ার রিসার্চ সেন্টার আর একটি কুঁড়ে ঘর। নিচে বয়ে চলেছে ভাগা নদী। ঐ কুঁড়েতেই আমরা ছিলাম।
অসম্ভব নির্জন সুন্দর জায়গা পাটসিও। উচ্চতা প্রায় ৩৬০০ মিটার। পৌঁছেই আমায় দ্রুত ঠান্ডা আর উচ্চতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি শুরু করতে হল। এবার শুরু হল একের পর এক বিপত্তি। প্রথমেই অমিতবাবু বললেন, তিনি আমাদের সঙ্গে বেসক্যাম্পে যাবেন না। ভদ্রলোকের বয়স ৭৫, মানালিতে এক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে এসেছিলেন। তাই, আর না এগোনোই ঠিক করলেন।
অগত্যা বাকি চারজন মিলেই ঘোড়াওয়ালার সঙ্গে যাত্রা শুরু করলাম। ঘোড়াওয়ালার নাম নোরবু, বয়স প্রায় ৭০, ঝাংস্কার ভ্যালির লোক। সিংকোলা পেরিয়ে দারচা এসেছিলেন কাজে, আমরা ধরে নিয়ে চলে এসেছিলা। প্রায়ই ঘোড়াদের সামলাতে পারছিলেন না, আমরাই টেনে নিয়ে উঠছিলাম।
প্রথম দিনের গন্তব্য ছিল পনছি নালার পাশে ট্রানজিট ক্যাম্প, উচ্চতা প্রায় ৪১০০ মিটার। অভীক ছাড়া সকলেরই মাথা যন্ত্রণা শুরু হয়েছিল। পরেরদিন সকালেও যখন সৌরভের মাথা যন্ত্রণা কিছুতেই কমল না, ওকে ফের পাটসিও নামিয়ে একাধিক নদী পেরিয়ে একা সোজা বেস ক্যাম্প উঠে এলাম। বাকিরা আগেই বেসক্যাম্প পৌঁছে গিয়েছিল। বেসক্যাম্পের উচ্চতা প্রায় ৪৬০০ মিটার।
বেসক্যাম্পে এখন আমি, সুমন আর অভীক। অভীক গত একমাস ধরে একা গ্রেটার হিমালয়ে সাইক্লিং করছে। পাটসিওতে সাইকেল রেখে আমাদের সঙ্গে জয়েন করেছিল। আবার নেমে গিয়ে লেহর দিকে চলে যাবে। কিন্তু, নদী পেরিয়ে ওরও জ্বর চলে এল। অর্থাৎ, দুজন ক্লাইম্বিং মেম্বারের মধ্যে সুমন ক্লান্ত, আমি দ্রুত অ্যাডজাস্ট করার চেষ্টা করছি। বেসক্যাম্প মেম্বার অভীকের জ্বর। আর কেউ নেই সাহায্য করার জন্য। একটা দিন রেস্ট নিলাম সবাই বেসক্যাম্পে।
পরেরদিন মানে ১৫ তারিখ ক্যাম্প ১-এ লোড ফেরি শুরু করলাম। মোরেন জোন পেরিয়ে ক্যাম্প ১-এর উচ্চতা প্রায় ৫০৬০ মিটার। রাস্তায় স্নোফিল্ডগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ, প্রায়ই কোমর অবধি বসে যাচ্ছিল। সুমন এরকম স্নো কন্ডিশানে আগে পড়েনি। বেশ চিন্তিত মনে হল। আমিও আশা করিনি এরকম বরফের অবস্থা।
১৬ তারিখ ক্যাম্প ১ দখল করলাম, তারপরেই ভয়ানক স্নো-ফল শুরু হল। এবার আমারও শুরু হল দুশ্চিন্তা। আমাদের পরিকল্পনা ছিল সামিট ক্যাম্পে পৌঁছে চারদিন বসে থেকে একে একে চারটে শৃঙ্গ জয় করা। তাই বিপুল খাবার, গ্যাস, ইকুইপমেন্ট, টেন্ট ছাড়াও নিজেদের স্লিপিং ব্যাগ, পোশাক তুলতে হত। সেই বিপুল ওজন এই সফট স্নোয়ের মধ্যে দিয়ে তোলা অসম্ভব। তবু চেষ্টা করলাম পরেরদিন ভোর চারটের দিকে। সবে স্নো-ফল থেমেছে। উপরে পুরো হোয়াইট আউট। সামনের পিক বা কল কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সুমন এগোনোর চেষ্টা করল, কোমর অবধি ঢুকে গেল। বাধ্য হয়ে ফিরে এল। সেদিনের এগোনো বাতিল করলাম। খানিক বাদেই ফের স্নো-ফল শুরু হল।
সারাদিন ধরে দেখলাম বাইরের কালো মেঘ আরো ঢুকছে। ধীরে ধীরে দুজনেই উৎসাহ হারাচ্ছি, মনের মধ্যে ধীরে ধীরে ভয় ঢুকছে, এরকম ভয়ানক আবহাওয়ায় বিপদে পড়লে সাহায্য করার জন্য তৃতীয় কোনো ব্যক্তিও নেই। এবার পরিকল্পনা পাল্টালাম, যেটা সম্ভবত এর আগে কেউ করেনি।
ঠিক করলাম, খালি স্যাকে শুধুমাত্র বিউটেন বার্নার, খানিক ড্রাই ফুড নিয়ে ক্যাম্প ১ থেকে সোজা KR2 উঠব, তারপর নেমে চলে আসব। এই রকম লম্বা হাঁটা আমরা আগেই প্র্যাক্টিস করেছি, এবার প্রয়োগের পালা।
রাত ১১টা, তখনো মুষলধারে স্নো-ফল চলছে। রাত ১২টা, দেখলাম স্নো-ফল খানিক কমেছে। রাত ১টা, দেখলাম স্নো-ফল থেমেছে, কিন্তু হোয়াইট আউট রয়েছে। রাত ২টো, দেখলাম ঝকঝকে আকাশ দেখা যাচ্ছে। চটপট বিউটেন জ্বালিয়ে দুধ, ওটস খেয়ে রেডি হয়ে গেলাম।
রাত ৩টে, দুজনে রোপড আপ হয়ে বেরলাম। তখনো হাওয়া চলছে, পিকের উপরে মেঘ জমে আছে। নিজেরই খানিক ভয় জমে আছে, সামনে কী অপেক্ষা করছে জানি না। সুমনকে কিছু বললাম না, এগিয়ে গেলাম রুট ওপেন করতে করতে। মনে মনে ভাবলাম, আজকেই সেই দিন, যার জন্য এত্ত কিছু আত্মত্যাগ। যতটা ক্লাইম্ব করব, সেটা আমার ক্লাইম্ব, আমাদের ক্লাইম্ব।
প্রথম বিপত্তি, হেলমেট পরতে হেডটর্চ মাথা থেকে কপালে চলে এল। বেল্ট লুজ হয়ে কপাল থেকে নাকের উপর ঝুলছে। বিরক্ত হয়ে হেডটর্চ গলায় নামিয়ে দিলাম, ওই ঠাণ্ডায় গ্লাভস খুলে অন্ধকারে বেল্ট ঠিক করার সামর্থ্য ছিল না। মাঝেমধ্যে আলো পাচ্ছিলাম, বারে বারে হেডটর্চ জ্যাকেটের পেছনে চলে যাচ্ছিল।
দ্বিতীয় বিপত্তি, ফ্রেশ স্নোতে বারবার কোমর অবধি ঢুকে যাচ্ছিলাম। পা পুরো জমে যাচ্ছিল সঙ্গে সঙ্গেই। ফের হাত দিয়ে স্নো খুঁড়ে খুঁড়ে পা বের করতে হচ্ছিল। ওই ঠাণ্ডায়, ওই উচ্চতায় এসব করতে করতে বারে বারে হাঁসফাঁস করছি, দম নিয়ে ফের সামনের দিকে যাচ্ছি। ভোররাতেও স্নো এত নরম দেখে সত্যিই আশাহত হয়ে পড়েছিলাম।
তৃতীয় বিপত্তি, উপরের আবহাওয়া আর আমার বারেবারে বরফে ঢুকে যাওয়া দেখে সুমন ফিরে যাওয়ার জন্য বলতে লাগল পেছন থেকে (এভাবেই অন্ধকারে ক্রিভার্সের মধ্যে ঢুকে গেলে ওই ওয়েদারে রেস্কিউ প্রসেস খুবই জটিল হয়ে যেত)। তবুও সেল্ফ রেস্কিউতে ভরসা রেখে আমি বরফ ঠেলে এগোচ্ছিলাম। লিডারসুলভ মোটিভেশন দেওয়ার জায়গায় আমি সত্যিই তখন ছিলাম না, আমি নিজে কখনো এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হইনি।
চতুর্থ বিপত্তি, আমার হাত জমে আসছে। ওই হাওয়া আর বরফ ঘাঁটাঘাটিতে গ্লাভস প্রায় কোনো কাজ করছে না। আঙুলের ডগাগুলোতে অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হয়েছে।
বাধ্য হলাম ক্যাম্পের দিকে ফিরতে, আর পিকের দিকে মুখ তুলেও তাকাইনি। পাহাড় আমায় শিখিয়েছে, প্রত্যাশা রেখে পাহাড়কে ভালোবাসা যায় না। আমি সবকিছু পাহাড়কে দিয়েছি মানেই পাহাড় সবকিছু ফিরিয়ে দেবে, এমন কোনো মানে নেই। প্রত্যাশার চাপ অন্য সব সম্পর্কের মধ্যে থাকে, পাহাড়কে ভালোবাসার মধ্যে থাকে না...
গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারত, কিন্তু নামার সময় কোনো ঘোড়াওয়ালা বেসক্যাম্পে আসেনি। খাবারদাবার, কেরোসিন, ইক্যুপমেন্টস সহ অনেক কিছুই বেসক্যাম্পে গুছিয়ে রেখে ছেড়ে এসেছিলাম, পরবর্তী টিম ও ভেড়াওয়ালাদের কাজে লেগে যাবে বলে। তারপরেও তিনজনে মিলে প্রায় ১২০ কেজি ওজন দুদিনে বেসক্যাম্প থেকে খরস্রোতা নদী পেরিয়ে নিচে নামিয়ে এনেছি।
তারপর আমি খানিক স্বস্তির নিশ্বাস নিতে পেরেছি। দুসপ্তাহের ছুটি ঝড়ের মতই শেষ হল। শেষ একবছর শারীরিক প্রস্তুতির দিকে নজর দিতে গিয়ে পরিকল্পনার দিকটায় অনেক খামতি রয়ে গিয়েছিল। আল্পাইনিজমের জন্য আরো অনেক ইনোভেটিভ প্ল্যানিং-এর প্রয়োজন। আরো অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রয়োজন। সত্যি বলতে আমাদের অভিযানে অনেক পুরনো ঝোঁক রয়ে গিয়েছিল। সেগুলো আরো ভালোভাবে কেটে বাদ দিতে হবে, নিজেদের আরো শক্তভাবে প্রস্তুত করতে হবে।
শুরু করলাম আরো শক্ত প্রস্তুতি।
(ক্রমশ)