সিনে-পর্দায় ফিরছেন এ যুগের শ্রীকান্ত

“ভ্রমণ করা এক, তাহা প্রকাশ করা আর। যাহার পা-দুটা আছে, সেই ভ্রমণ করিতে পারে; কিন্তু হাত দুটা থাকিলেই ত আর লেখা যায় না। সে যে ভারি শক্ত। তা ছাড়া মস্ত মুস্কিল হইয়াছে আমার এই যে, ভগবান আমার মধ্যে কল্পনা—কবিত্বের বাষ্পটুকুও দেন নাই। এই দুটো পোড়া-চোখ দিয়া আমি যা কিছু দেখি ঠিক তাহাই দেখি। গাছকে ঠিক গাছই দেখি—পাহাড়-পর্ব্বতকে পাহাড়-পর্ব্বতই দেখি। জলের দিকে চাহিয়া, জলকে জল ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না! …এমন করিয়া ভগবান যাহাকে বিড়ম্বিত করিয়াছেন, তাহার দ্বারা কবিত্ব সৃষ্টি করা ত চলে না। চলে শুধু সত্য কথা সোজা করিয়া বলা। অতএব আমি তাহাই করিব।”
শুটিং-এ 'রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত' ছবির টিম
‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের প্রথম পর্বের প্রথম পরিচ্ছেদে এই কথাগুলিই লিখেছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। আসলে শরৎচন্দ্রের কথন যতটা না মানুষের বহির্প্রকৃতি, তার চেয়েও বেশি মানুষের ভিতরের জার্নি। অন্তত শ্রীকান্ত উপন্যাসের চারটি পর্বে তা লক্ষণীয়। শ্রীকান্ত আদতে একটি সিনেম্যাটিক উপন্যাস। যে কারণে চলচ্চিত্র নির্মাতারা এমন লেখায় মুখিয়ে থাকেন। প্রতিটি চরিত্রের নিপুণ বর্ণনা থেকে শুরু করে ঘটনা পরম্পরা আর প্রত্যেকটি ফ্রেম যেন জীবন্ত। শ্রীকান্তর ভিতরের পাগলামিটা প্রত্যেকটি সিনেমায় পরিচালকেরা দক্ষ হাতে সামলেছেন। আমাদের বাংলায় শ্রীকান্তকে নিয়ে প্রায় পাঁচটি ছবি ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে। হরিদাস ভট্টাচার্য ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৫ সময়কালে বানিয়ে ফেলেছেন তিনটি ছবি- ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’ (১৯৫৮), ‘ইন্দ্রনাথ শ্রীকান্ত ও অন্নদাদিদি’ (১৯৫৯) এবং ‘অভয়া ও শ্রীকান্ত’ (১৯৬৫)। শ্রীকান্তর চরিত্রে অভিনয় করেছেন যথাক্রমে উত্তম কুমার, সজল ঘোষ এবং বসন্ত চৌধুরী। উত্তম কুমারের অভিনয়ের দৃপ্ততা আর রাজলক্ষ্মীর সঙ্গে তাঁর মধুর বাক্য বিনিময়ে সে সময় বাঙালি দর্শক পাগল হয়েছিল। কিংবা বসন্ত চৌধুরীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আজও সিনে-প্রেমী বাঙালি ভুলতে পারেনি। পরবর্তীকালে হরিসাধন দাশগুপ্ত উত্তম কুমারকে নিয়েই তৈরি করেছিলেন ‘কমললতা’ (১৯৬৯)। তবে রাজলক্ষ্মীর সঙ্গে শ্রীকান্তর সম্পর্ক আগের ছবিটির মতো ধরা দেয়নি। দেখা যায়নি উত্তম-সুচিত্রা কেমেস্ট্রি।
আরও পড়ুন
জীবনের খোঁজে উড়ে যাচ্ছে ‘উড়নচণ্ডী’রা
বাঙালির অস্থিমজ্জায় এমন কিছু চরিত্রের ভিড়, তাতে কোনওদিন মরচে পড়ে না। চরিত্রকে নিয়ে রোমান্টিসাইজ করা থেকে, তাকে ঘিরে জীবনের একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ করতে চায় জনপ্রিয় উপন্যাস গোগ্রাসে গিলে ফেলা বাঙালি। ঠিক তার মতোই হয়ে ওঠা কিংবা তার হাত ধরে চলা বন্ধুটি হয়ে। ঠিক এমনই একটি চরিত্র শ্রীকান্ত লেখা হচ্ছে আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে। আজও তা প্রাসঙ্গিক। আজও পরিচালকেরা আশ্রয় নিচ্ছেন শ্রীকান্তে। তাঁকে সমকালীন করে নিজ হাতে গড়ে-পিটে নিচ্ছেন। তাই শ্রীকান্ত আবার আসছেন নতুন ভাবে পরিচালক অঞ্জন দাশের হাত ধরে। তাঁর ‘ইতি শ্রীকান্ত’ (২০০৪) ছবিতে শ্রীকান্তর চরিত্রে অভিনয় করেছেন আদিল হুসেন। তবে ছবিটি দর্শকমনে তেমন দাগ কাটতে পারেনি। আবার প্রায় ১৪ বছর পর শ্রীকান্ত ফিরছেন বাঙালির ঘরে। পরিচালক প্রদীপ্ত ভট্টাচার্যের হাত ধরে এবার শ্রীকান্ত হয়ে আসছেন ঋত্বিক চক্রবর্তী। উত্তম কুমার – বসন্ত চৌধুরীদের হয়ত যোগ্য উত্তরসূরি।
শুটিং-এ 'রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত' ছবির টিম
এক্ষেত্রে শরৎচন্দ্রের মূল কাহিনি খুব সরাসরি নেওয়া হয়নি। এমনকি পরিচালক এই ছবিতে সংযোজন করেছেন সম্পূর্ণ নতুন একটি চরিত্র। সময়ের সঙ্গে মূল গল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য পর্দায় হাজির করছেন এ যুগের শ্রীকান্তকে। শ্রীকান্তরা বাঙালি মননে এখনও এভাবেই বাঁচেন। “রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত” মূল উপন্যাসের প্রথম পর্ব আশ্রিত। ছবিতে শ্রীকান্তর চরিত্রে দেখা যাবে ঋত্বিক চক্রবর্তীকে, রাজলক্ষ্মী হিসাবে থাকছেন বাংলাদেশের অভিনেত্রী জ্যোতিকা জ্যোতি এবং অন্নদাদিদির ভূমিকায় অপরাজিতা ঘোষ। শ্রীকান্তর ভাষা গ্রাম নগরের কোলাহল পেরিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে থাকে না, সেই ভাষা দিগ্বিদিকে ছড়িয়ে যায়। লোকমুখে প্রচলিত হয়ে যায়। শরৎচন্দ্রের আর পাঁচটা উপন্যাসের মতো শ্রীকান্ত কখনই পাশের বাড়ির ছেলেটি হতে পারে না, বরং তাকে বা তার ভালোবাসাকে সম্মান জানাতে হয় দূর থেকেই। এ এক উপলব্ধির কঠিন পথ চলা। শ্রীকান্তরা আমাদের বন্ধু হয়ে যান। রাজলক্ষ্মীর প্রতি তার অনুভবের মাত্রা বিস্তৃত পাহাড় পার করে তুলে আনে নির্জনতা। আর তাই শ্রীকান্ত এখনও প্রাসঙ্গিক। প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য এর আগে ‘বাকিটা ব্যক্তিগত’র মতো ছবি বানিয়ে বাঙালি দর্শককে শ্রেষ্ঠ ভালোবাসার সোজাসাপ্টা গল্প উপহার দিয়েছেন। পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কার। তাঁর সেই মোহিনী গ্রামেই হয়ত এবার শ্রীকান্ত পৌঁছে যাবে। ওই গ্রামেই হয়ত আজকের শ্রীকান্ত আবিষ্কার করবে ইন্দ্রনাথ, রাজলক্ষ্মী, কমললতা বা অন্নদা দিদিকে। শরৎচন্দ্র আবার জাঁকিয়ে বসবেন বাঙালি মননে।