কথাবলা ফ্যাক্স মেশিন এবং গডসে মিটার

কথাবলা ফ্যাক্স মেশিন। দুর্লভ তো বটেই। দেশে এক পিসই আছে। তবে এত দিন ব্যাপারটা গোপন রাখা হয়েছিল। জম্মু-কাশ্মীরের রাজ্যপাল সত্যপাল মালিকের ফ্যাক্স মেশিন যে কথা বলতে পারে, আগে আমাদের কারোরই তা জানা ছিল না। সম্প্রতি, কাশ্মীরের প্রধান দুই আঞ্চলিক দলের নেতা ওমর আবদুল্লা এবং মেহবুবা মুফতি একজোট হয়ে সেখানে সরকার গড়তে চেয়ে রাজ্যপালকে ফ্যাক্স পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু, সেই ফ্যাক্স রাজভবনে পৌঁছলই না। উলটে, রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয়ে গেল জম্মু-কাশ্মীরে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। এসব তো টিভিতে খবরের কাগজে সবাই দেখেছে। কিন্তু, কী হয়েছিল রাজ্যপালের ফ্যাক্স মেশিনে যে হিন্দুত্ববিরোধী দুটি দলের সরকার গড়ার ফ্যাক্স পৌঁছলই না রাজভবনে? সেটাই জানা গেল ওই ফ্যাক্স মেশিনের এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারে। সাংবাদিকের নাম দেশবিরোধী বসু। সংক্ষেপে দেব। দেব যখন রাজভবনের চারপাশে উঁকি ঝুঁকি মারছেন, তখনই হঠাৎ চোখে পড়ল, লাল তিলক কেটে ‘পহলে মন্দির পিছে সরকার’ স্লোগানটা গুনগুন করে ‘ভজ গৌরাঙ্গ, কহ গৌরাঙ্গ’-এর সুরে গাইতে গাইতে ফ্যাক্স মেশিনটা বাগানে একা একা পায়চারি করছে। এর পর দুজনে এরকম কথা হল--
দেব- স্যার.. ও স্যার, একটু এই বেড়ার দিকে আসবেন?
ফ্যাক্স- (হেসে, কাছে এসে, ওহ! তুমি..) বল কী জানতে চাও?
দেব- এই যে নতুন সরকার গড়ার চিঠির ফ্যাক্স রাজভবনে এসে পৌঁছলই না, এটা যদি একটু খোলসা করে বলেন!
ফ্যাক্স- আচ্ছা, এটা জানতে হলে আগে বলুন আমাদের রাজ্যপালের নাম কি?
দেবু- ক্যানো.. সত্য মালিক।
ফ্যাক্স- ভুল বললেন। সত্যপাল মালিক। সমাস করলে সত্যের পালের মালিক যিনি। পাল মানে কিন্তু নৌকার পাল নয় বা আপনাদের ওই গোষ্ঠ পাল, বিপিন পাল, সেই পাল নয়। পড়েননি, ‘রাখাল গরুর পাল লয়ে যায় মাঠে...’ সেই পাল...তবে কী না রাজ্যপাল তো, গরুর পালের সঙ্গে তুলনা মোটেই ভাল দেখায় না। যদি বলতেই হয় তা হলে হাতির পাল বলুন। এক পাল হাতি, সে তো আমরা বলেই থাকি। তা বলে, রাখাল হাতির পাল লয়ে যায় মাঠে অবশ্য বলা যাবে না। যাই হোক, উনি হলের সত্যপাল। সত্যের পাল, বা বলা যায় এক পাল সত্যকে সঠিক দিকে তাড়িয়ে নিয়ে চলেছেন। এই রাজ্যে ওঁকে পাঠানোই হয়েছে সত্য প্রতিষ্ঠা করতে।
দেব- তো...
ফ্যাক্স- আমাদের এখানে কী জানেন তো, মিথ্যা-বিরোধী ডিটেকটর বসানো আছে। তার নাম ‘গডসে মিটার’। মিথ্যা বললেই ওই মিটারে ঘণ্টা বেজে ওঠে। অবশ্য সব মিথ্যা নয়। মিথ্যাকে আমরা দু’রকমের মনে করি। এক হল জাতীয়তাবাদী মিথ্যা। তাতে ঘণ্টা বাজবে না, কিন্তু আপনি বেহালার করুণ সুর শুনতে পাবেন। যেমন ধরুন আপনি বললেন, বছরে দু’কোটি লোককে চাকরি দেবেন, বেহালা বাজবে। আপনি বললেন কালো টাকা ফিরিয়ে এনে সবার অ্যাকাউন্টে ১৫ লাখ করে দিয়ে দেবেন, বেহালা বাজবে। কিন্তু যেই বলবেন গৌরী লঙ্কেশ গুলিতে নিহত, অমনি ঢং, ঘণ্টা বেজে উঠবে।
দেব- কেন কেন? গৌরী লঙ্কেশকে তো গুলি করে খুন করা হয়েছে!
ফ্যাক্স- হয়েছে, কিন্তু সেটা হল গিয়ে একটা দেশবিরোধী সত্য। ও আমাদের লাগে না। তেমনি সেদিন দুপুরে যখন খুট খাট শব্দ করে মওকা বুঝে সরকার গড়ার ফ্যাক্সটা ঢুকব ঢুকব করছে, ঠিক তখনই ঢং ঢং ঢং করে ঘণ্টা বেজে উঠল। আমি ভয়ে সুইচ অফ করে দিলাম। যেমন, বিদ্যুৎ চমকালে আপনারা করে থাকেন টিভি, এসিতে, সেরকম অনেকটা। আমাদের কাছে খবর আছে, ওই সময়ে পাকিস্তানে বেহালার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। তাছাড়া, ভাবুন একবার, মেহবুবা মুফতি, ওমর আবদুল্লরা সরকার চালাবে? জাতীয়তাবাদীরা কি বানের জলে ভেসে এসেছে?
দেব- বলছেন ওরা জাতীয়তাবাদী নয়? কিন্তু, ওদের সঙ্গে তো আপনারা অতীতে জোট-সরকার চালিয়েছেন? তাছাড়া, রাজ্যটায় সন্ত্রাসবাদীদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে, তাতে কি পাকিস্তানেরই লাভ হচ্ছে না? দুটি স্থানীয় দলের সরকার থাকলে হয়তো পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিকের দিকে এগোতো। সেই চেষ্টাটাই তো করা গেল না!
ফ্যাক্স- শুনুন, আমি রাজ্যপালের ফ্যাক্স। আমাকে প্রশ্ন করবেন না। সেটা ভাল দেখায় না। (হেসে) বসুন, চা খান। একটা টাটকা জাতীয়তাবাদী মন নিয়ে বাড়ি যান। আপনার কথা শুনে ওই গডসে মিটারটা কেমন গোঁ গোঁ করছে। লক্ষণ মোটেই ভালো ঠেকছে না। এখন আসুন।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)